টিংকু মণ্ডল: একবিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আজকের জেনারেশনের কাছে সবচেয়ে থেকে আকর্ষণীয় বিষয় হল মোবাইল, ইন্টারনেট ও সোশাল মিডিয়ায় নিজের স্ট্যাটাস আপডেট করা৷ এমনকি এই চটকদারিতে পিছিয়ে নেই এখনকার টিনেজাররাও৷ তাদের কাছে সব থেকে প্রিয় বিষয় হল ইন্টারনেট গেম ও একবিংশ শতাব্দী ‘ক্রাশ’ শব্দটিকে তারা তাদের গেমিং সুপার হিরোদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করে থাকে৷
নব্বইয়ের দশকে ভারতীয়দের কাছে অন্যতম প্রিয় ‘গেম’ হল ক্রিকেট এবং গেমিং ক্রাশ বলতে সেই সময়কার জনপ্রিয় খেলোয়াড়দের নাম৷ যাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রাহুল শরদ দ্রাবিড়৷ তাঁর ব্যক্তিত্ব, লুকস, স্টাইল, ব্যাটিংয়ের ধরন ও স্মার্টনেস সবকিছু নিয়ে তিনি ছিলেন অনবদ্য৷ তাঁর সবথেকে আকর্ষণীয় যে বিষয়টি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করত তা হল, তাঁর নম্রতা ও ভদ্রতা৷ আর সব থেকে বেশি যে জিনিটির প্রতি সব মেয়েরা পাগল ছিল, তা হল স্মাইল৷
রাহুল দ্রাবিড় সে সময় শুধুমাত্র অষ্টাদশী মহিলাদেরই নয়, মন জয় করে ছিলেন টিনেজারদেরও৷ সেই সময় নেটদুনিয়া ও সোশাল মিডিয়ায় এখনকার মতো আড়ম্বর ছিল না৷ তাই, সেই জেনারেশনের কাছে একটা দু’ টাকা দামের পোস্টকার্ডই ছিল অনেক বেশি দামি৷ শুধু পোস্ট কার্ডই নয়, যে কোনও ক্রিকেটবুক থেকে পাওয়া ছবি এমনকি পেপার কাটিংয়ের চল ছিল প্রচুর৷ পেপসির বোতোলের গায়ে লাগানো ব়্যাপার থেকে শুরু করে পোস্টকার্ড, স্ট্যাম্প সাইজ ফোটো সবকিছুকেই ডায়েরিতে স্মৃতি হিসেবে সংগ্রহ করে রাখা ছিল টিনেজারদের কাছে অনেকবেশি গুরুত্বপূর্ণ৷
তখন ভারতীয় ক্রিকেট দলে রাহুল দ্রাবিড় ও সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের জুটি ছিল অনবদ্য৷ ১৯৯৯ সালের ২৬ মে, টনটনে বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক ইনিংস খেলে ক্রিকেটবিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন টিম ইন্ডিয়ার এই দুই তরুণ তুর্কি৷ ওয়ান ডে ক্রিকেটে প্রথমবার তিনশোর পার্টনারশিপের রেকর্ড গড়েছিলেন রাহুল ও সৌরভ৷ ম্যাচে দ্রাবিড় মাত্র ১২০ বলে একটি ছক্কা ও ১৭টি বাউন্ডারি হাঁকিয়ে ১৪৫ রানের ইনিংস খেলেছিলেন৷ যা ছিল ‘দ্য ওয়াল’-এর স্বভাববিরুদ্ধ৷ সৌরভ-রাহুলের এই পার্টনারশিপ ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে স্বর্ণময় মুহূর্ত হিসেবে লেখা হয়েছে৷ সৌরভ বাঙালি হিসেবে আমাদের মনে এক আলদা জায়গা করে নিয়েছিলেন৷ কিন্তু প্রচুর বাঙালি টিনেজার থেকে শুরু করে বয়স্ক ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে ‘ঘরের ছেলে’ হয়ে উঠেছিলেন দ্রাবিড়৷
নিজের ড্যাশিং পার্সোনালিটি দিয়ে টিনেজারদের স্বপ্নের নায়ক হয়ে উঠেছিলেন রাহুল৷ সেই সময় এখনকার মতো সারা বছর ধরে ক্রিকেটেদর দাপাদাপি ছিল না৷ ছিল না টি-২০ বা আইপিএল-এর মতো জনপ্রিয় ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ৷ ফলে সে সময় ভারতীয় দলের খেলা মানেই সবার মনে আলাদা উদ্বেগ থাকত৷ বাংলা মিডিয়াম স্কুলের পরীক্ষার সময় টিভি-তে ভারত-পাক ম্যাচ থাকলেও তা যেন কিছুতেই মিস করা যেত না৷ তখন অংক পরীক্ষার যোগ-বিয়োগ, গুণ-ভাগকে দূরে সরিয়ে রেখে বাইশ গজে কোনও খেলোয়াড় কত রান করল বা কোন দল কত উইকেট হারাল তা জেনে ওঠাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ৷ আর এই হিসেব থেকে বাদ পড়তেন না দ্রাবিড় নিজেও৷
টিভি-র ওপারে রাহুলের রানের যোগ-বিয়োগ হিসেব করতে বসতেন টিভি-র এপারে থাকা ক্রিকেটপ্রেমীরা৷ তখনকার টিনেজারের কাছে রাহুলের জনপ্রিয়তা আজও বিদ্যমান৷ সেদিনের টিনেজার আজ মাঝ বয়সি মহিলা হয়ে উঠলেও পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই দ্রাবিড়ের প্রেমে মশগুল৷ সদ্য ভারতীয় দলের কোচ হয়ে শ্রীলঙ্কা সফরে যাওয়া দ্রাবিড় দু’দশক আগের সেই প্রেমকেই যেন আবার প্রাণবন্ত করে তুললেন৷ ক্রিকেটের ‘দ্য জেন্টেলম্যান’ আজও তাঁর ফ্যানদের মনের মণিকোঠায় জায়গা ধরে রেখেছেন৷