Pataliputra: পিস্তল নাচিয়ে গান্ধীবাদী হাইজ্যাকার কৈরালার হুমকি, বিহারের মাঠে বিশ্ব কাঁপল

প্রসেনজিৎ চৌধুরী: বিহারের মারকাটারি রাজনৈতিক ঘটনাক্রমের গত পাঁচ দশকে জড়িয়ে আছে বিমান সংক্রান্ত দুটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা। একটি ঘটেছিল ‘৭০ দশকে। আর একটি ‘৯০ দশকের। দ্বিতীয়টি…

প্রসেনজিৎ চৌধুরী:
বিহারের মারকাটারি রাজনৈতিক ঘটনাক্রমের গত পাঁচ দশকে জড়িয়ে আছে বিমান সংক্রান্ত দুটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা। একটি ঘটেছিল ‘৭০ দশকে। আর একটি ‘৯০ দশকের। দ্বিতীয়টি পশ্চিমবঙ্গ সহ পুরো দেশকে জড়িয়ে একেবারে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তুলকালাম ফেলে দেয়। পর্যায়ক্রমে সে কথায় পরে আসতেই হবে। আগে সত্তর দশকে ডানা মেলে দিই। (Pataliputra)

সীমান্ত শহর বিরাটনগর, নেপাল
১০জুন, ১৯৭৩
ঠিক সময়েই ভারত সীমান্তবর্তী নেপালের বিরাটনগর বিমানবন্দর থেকে কাঠমাণ্ডুর দিকে উড়ে গেল রয়াল নেপাল এয়ারলাইনসের ছোট্ট প্লেন। যাত্রী সবমিলে উনিশ জন। সকাল সাড়ে আটটা বাজে। বিমান টেক-অফের কিছু পরেই দুই নিরীহ যাত্রী আচমকা পিস্তল, গ্রেনেড বের করে লাফ দিয়ে ককপিটের কাছে চলে গেল। নেপালি ও হিন্দিতে তারা বিমান ধংস করার হুমকি দিতে শুরু করে। একজন পরিষ্কার নেপালি ভাষায় জানায়, বিমানটি হাইজ্যাক করা হয়েছে। পিস্তল দেখিয়ে পাইলটকে হুকুম দেওয়া হয় বিমান নামাতে। মাঝ আকাশে সে এক রোমহর্ষক কান্ড। যাত্রীরা আতঙ্কিত। প্রাণভয়ে কাঁপতে কাঁপতে পাইলট কয়েকবার আকাশে চক্কর কেটে বুঝলেন ল্যান্ড করার জায়গা নেই। এদিকে ঘাড়ের কাছে পিস্তলের ঠান্ডা নলের ছোঁয়া লাগছে। সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত হাজির। তাদের নির্দেশ- বিমান নামাতেই হবে। কোনওরকমে একটা ঘাস জমির উপরে সেই বিমান নামাতে পারলেন পাইলট।

বিহার
এই জায়গাটার নাম ফরবেসগঞ্জ। বিহারের একটি মাঝারি জনপদ। তৎকালীন পূর্ণিয়া জেলার ফরবেসগঞ্জ এখন উত্তর বিহারের আরারিয়া জেলার মধ্যে পড়ে।সেখানেই বিমানটা নামল। যাত্রীরা ভয়ে কাঁপছেন। তবে অপহরণকারীরা জানায় কারোর ক্ষতি হবে না। নেপাল রাজার বিরুদ্ধে এই গেরিলা হামলা চালানো হচ্ছে। বলে কী এরা! রাজার বিরুদ্ধে লড়ছে নাকি, হতচকিত যাত্রীদের মধ্যে কয়েকজন মনে মনে সাবাসি জানালেন হয়ত। মুখে কিছু বলার সাহস হলো না। যদি গুলি চালিয়ে দেয়। বিমানে ছিল নেপাল রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের তিরিশ লক্ষ টাকা। সবই ভারতীয় নোট। অপহরণকারীরা জানায় বিদ্রোহ পরিচালনা করতে ওই টাকা লুঠ করা হচ্ছে।

https://video.incrementxserv.com/vast?vzId=IXV533296VEH1EC0&cb=100&pageurl=https://kolkata24x7.in&width=300&height=400

ফরবেসগঞ্জের সেই ঘাসে ঢাকা মাঠের পাশে জঙ্গল। সেখানে তিনটি জিপ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন নেপালি কংগ্রেসের মোস্ট ওয়ান্টেড নেতা গিরিজা প্রসাদ কৈরালা, সুশীল কৈরালা আর তাঁদের ভারতীয় বন্ধুরা। বিমানটি নামতেই লুঠ করা টাকার ট্রাঙ্ক জিপে তুলে নিলেন সবাই। জিপটা এবড়ো খেবড়ো পথ ধরে জঙ্গলের পাশ দিয়ে দ্রুত চলে গেল। বিমান অপহরণ, টাকা লুঠ সব পরিকল্পনা মাফিক হতেই গোপন আস্তানায় আশ্রয় নিলেন নেপালি কংগ্রেসের নেতারা। বিমানটি ফের কাঠমাণ্ডুর দিকে উড়ে গেল।

নেপাল রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের  জন্য বরাদ্দ টাকা ভারত থেকেই যেত তখন। সেবারও নিয়ম করে বিহারের আরারিয়া থেকে সড়ক পথে নেপালের বিরাটনগরে টাকার ট্রাঙ্ক পাঠানো হয়েছিল। এ ব্যাপারটা অজানা ছিল না নেপালি কংগ্রেস নেতাদের। বিদ্রোহ পরিচালনার জন্য বিরাটনগর থেকেই লুঠ করার ছক করা হয়। পরিকল্পনা সফল হয়। বিমান নামিয়ে টাকা লুঠ যখন ফরবেসগঞ্জের সেই মাঠে হচ্ছিল ততক্ষণে বিরাটনগর থেকে কাঠমাণ্ডু  বিমানবন্দরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের বার্তায় হৈ হৈ পড়ে গেছে। সেই খবর পৌঁছতেই নেপালের তরফে ভারতকে প্রবল কূটনৈতিক চাপ দেওয়া শুরু হয়। ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়েছে বিমান অপহরণ ও টাকা লুঠে জড়িত নেপালি কংগ্রেস।

নেপালের দাবি, যারা এমন করেছে তাদের জলদি গ্রেফতার করুক ভারত সরকার। বিহারের রাজনৈতিক অন্দরমহলে উদ্বেগ বাড়ছিল। কারণ, কংগ্রেস এই রাজ্যে ক্ষমতায়। আর কে না জানে, ভারত-নেপাল দুই দেশের কংগ্রেসের মধ্যে ‘মধুর’ সম্পর্কের কথা। ষড়যন্ত্রের পর্দা যত উঠছিল ততই বিব্রত হচ্ছিলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।

ফরবেসগঞ্জের সেই মাঠ থেকে জিপ তখন নির্দিষ্ট সেফ হাউসের দিকে চলে গিয়েছে। অপহরণকারীরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে। একবার খবর আসছে তারা দার্জিলিংয়ে লুকিয়ে আছে। আবার জানা যাচ্ছে বারাণসীর গলিতে তাদের দেখা যাচ্ছে। অথচ ধরা যাচ্ছে না। নেপাল থেকে কূটনৈতিক চাপে নাজেহাল ভারত সরকার। এই অবস্থায় কংগ্রেসের বিহার নেতৃত্ব গোপনে তাদের নেপালি কংগ্রেসের বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। দু’পক্ষের আলোচনায় ঠিক হয় পরিস্থিতি সামলে নেওয়া হবে। সবুজ সংকেত আসার পর বিমান অপহরণে জড়িত গিরিজা প্রসাদ কৈরালা, সুশীল কৈরালা সহ কয়েকজন ধরা দেন। তাঁদের ভারতেই গ্রেফতার করা হয়। তবে লুঠ করা সেই টাকার হদিস মেলেনি।

১৯৭৩ সালের পর পরিস্থিতি দ্রুত বদলাচ্ছিল। ভারতে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ক্ষোভ দানা বাধছিল। প্রতিবেশি নেপালে সে দেশের কংগ্রেসের নেতৃত্বে রাজতন্ত্র বিরোধী আন্দোলন জমাট হচ্ছিল।  ১৯৭৫ সালে ভারতে জরুরি অবস্থা জারি ও তুমুল সরকার বিরোধী গণ আন্দোলনের ঝঞ্ঝাময় সময়। সেই ধাক্কায় ১৯৭৭ সালে জনতা সরকার দিল্লির ক্ষমতায় আসে। মুক্তি পান বিমান অপহরণকারী নেপালি কংগ্রেস নেতৃত্ব। ভারত থেকে নেপালে ফিরে তাঁরা  রাজতন্ত্র বিরোধী আন্দোলনে নেমে পড়েন।

রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে তীব্র সংঘর্ষের কেন্দ্র নেপাল। দশকের পর দশক এই সংঘর্ষ চলেছে গণ আন্দোলন ও সশস্ত্র পথে। ২০০৮  সালে নেপালে রাজতন্ত্র ধসে পড়ে। রাজপরিবার পুরোপুরি ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। আর নব্বই দশক থেকে যে রাজা নিয়ন্ত্রিত গণতান্ত্রিক কাঠামো চলছিল তাতে অংশ নিয়ে বারবার নেপালের প্রধানমন্ত্রী হয়ে নজির গড়েন গিরিজা প্রসাদ কৈরালা। পরে তাঁর ভাইপো সুশীল কৈরালা হন প্রধানমন্ত্রী।  দু’জনেই বিমান অপহরণ করে বিহার থেকে টাকা লুঠ করা স্বীকার করেছেন। নেপাল তথা উপমহাদেশের কিংবদন্তি এই দুই কংগ্রেস নেতা আদতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে জীবনভর সংগ্রাম করেছেন। সফল হয়েছেন। বিহারের মাটিতে এই বিমান অপহরণ ঘটনা তাঁদের সংগ্রামী জীবনের সফল অধ্যায়ের একটি। গণতন্ত্রাতিক অধিকারের জন্য বিমান অপহরণ, এমনই ব্যাখ্যা দিয়েছে নেপালি কংগ্রেস।

‘বে মওত কঁহি মর যায়ে না হম
অ্যায় জান-এ-ওয়াফা তু ইয়ে জুলম না কর… ‘
-সাহির লুধিয়ানভি

আর মালা সিনহা? সেদিন বিরাটনগর থেকে কাঠমাণ্ডুর  বিমান যাত্রী অভিনেত্রী এই প্রবীণ বয়সেও কূটনৈতিক কারণে পুরো ঘটনা কোনোদিন প্রকাশ করেননি। তবে তাঁর সামনেই যে সব ঘটেছিল, সেটি তদন্তে উঠে আসে। প্রবীণা অভিনেত্রীর মা জন্মসূত্রে নেপালি। কেন তিনি নীরব? আর কিছু বলার বাকি থাকে! (চলবে) 

গত পর্ব: Pataliputra: কংগ্রেস যেন মগধের ঘোড়া, হিমালয়ের নিচে গণতন্ত্রের জন্য ষড়যন্ত্র