Pataliputra: পোড়ানো হলো একসার জীবন্ত মানুষ, গণহত্যার গ্রামে ঢুকে ইন্দিরা বুঝলেন জয় সামনে

প্রসেনজিৎ চৌধুরী ঘাস আর খড়ের বড়বড় স্তূপের আগুনে জীবন্ত ছুঁড়ে ফেলা মানুষ তীব্র চিৎকার করছে বাঁচার জন্য। বন্দুক নিয়ে ঘিরে আছে কয়েকজন। জ্যান্ত মানুষ পোড়ানো…

প্রসেনজিৎ চৌধুরী
ঘাস আর খড়ের বড়বড় স্তূপের আগুনে জীবন্ত ছুঁড়ে ফেলা মানুষ তীব্র চিৎকার করছে বাঁচার জন্য। বন্দুক নিয়ে ঘিরে আছে কয়েকজন। জ্যান্ত মানুষ পোড়ানো হচ্ছিল। পুড়তে থাকা কয়েকজন বাঁচার জন্য খড়ের গাদা থেকে বেরিয়ে এলো। ঝলসে গেছে তাদের শরীর। চামড়া- মাংস খসে খসে পড়ছে। বাঁচার জন্য কেউ আগুনের কুন্ড থেকে বাইরে এলেই চলছে গুলি। সামনে মৃত্যু। পিছনে মৃত্যু। পুড়তে থাকা মানুষের কণ্ঠস্বর একসময় থেমে আসে। ঘন কালো ধোঁয়া আর পোড়া দেহের কড়া গন্ধে বেলচি গ্রাম ঢেকে গেল। সন্ধ্যা নামল নিয়ম করেই। এদিক ওদিক পড়ে আছে আধপোড়া দেহ। মৃতদেহগুলো নিয়ে কুকুরে মানুষে টানাটানি শুরু হয়েছে। একপক্ষ খেতে চায়। অন্যপক্ষ ‘নরসংহার’ প্রমাণ মটিতে পুঁতে দিতে মরিয়া। বিহারের মাটিতে এই গণহত্যার ভয়াবহ ঘটনা আধুনিক পাটলিপুত্রের (Pataliputra) রাজনীতি ছাড়িয়ে দিল্লিকে নড়িয়ে দিল।

১৯৭৭ সালের ২৭ মে পাটনা জেলার বেলচি গণহত্যা আসলে কুর্মি আর হরিজনদের সংঘর্ষ। দু’পক্ষের কেউ উঁচু শ্রেণীর না। অথচ তারাই বিভিন্ন কারণে পরস্পর সংঘর্ষে জড়াল। বেলচি গণহত্যা এই কারণে বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়ে আছে। মোট ১১ হরিজনকে জীবন্ত পুড়িয়েছিল কুর্মিরা। সেই দিনই ভারত ফের প্রমাণ দিল ”ফির ভি দিল হ্যায় হিন্দুস্তানি”। বেলচির ভয়াবহ গণহত্যার খবর ছড়িয়ে পড়ছিল পাটনা, দিল্লি হয়ে বিশ্বের সর্বত্র। আর গান্ধীবাদী সমাজবাদী জেপি (জয়প্রকাশ নারায়ণ) ভিতরে ভিতরে কুঁকড়ে যাচ্ছিলেন।

জেপি নেতৃত্বে ১৯৭৫ সালের বিহারের গণপ্রতিবাদ ছিল ইন্দিরা বিরোধী গণআন্দোলনের কেন্দ্র। ইন্দিরার পরাজয়ের ইতিহাস লেখা হয়েছিল বিহার থেকেই। আবার এই বিহার ভূমি থেকেই গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে ফের জয়ের রসদ পেয়েছিলেন ইন্দিরা। কেন্দ্রে জনতা সরকার চলছিল। আর বিহারে দুই অন্ত্যজ শ্রেণীর মধ্যে সংঘর্ষে জনতার গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল।জীবদ্দশাতেই নিজের তৈরি দুর্গের পতন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন জেপি। ১৯৭৭ সাল এমনই।

বেলচি গ্রাম বিহারের মাটিতে প্রথম জাতিবাদ ভিত্তিক কারণে রক্তাক্ত জমি। এই জমি থেকেই নিজেকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইন্দিরা। জাতিবাদ মানে শুধু কি উঁচু-নিচু জাতের লড়াই ? এই প্রশ্নের ভিন্ন উত্তর দিয়েছে বেলচি গ্রামের মানুষ পোড়া গন্ধ। ভয়ঙ্কর সেই উত্তর। জিঘাংসা-ক্রূরতা দেখেনা ধর্ম, জাতি, বর্ণ। যেমনটা হয়েছিল বেলচি গ্রামে হরিজন ও কুর্মিদের লড়াইয়ে।

এই নরসংহার যখন ঘটে তার কিছু আগে ভারত মুখ ফিরিয়েছে কংগ্রেস থেকে। ক্ষমতায় নেই ইন্দিরা। বেলচি ‘নরসংহার’ তাঁর কাছে রাজনৈতিক  মোড় হয়ে চলে এলো। সটান দিল্লি থেকে পাটনা। তারপর পাটনা থেকে বেলচি। সে এক দুর্গম অতি আলোচিত ইন্দিরা যাত্রাকথা।

“जो लौटना चाहते हैं वे लौट जाएं, मैं तो बेलछी जाऊंगी ही।” – ইন্দিরা গান্ধী

প্রবল বর্ষায় বিচ্ছিন্ন হয়েছিল বেলচি গ্রাম। কী করে যাবেন ইন্দিরা! এসে গেল হাতি। বিহার প্রদেশ কংগ্রেসের বিশেষ উদ্যোগে হাতির পিঠে চড়ে বেলচি গ্রামে পৌঁছলেন ইন্দিরা গান্ধী। এই হাতি পার হয়েছে খরস্রোতা নালা, ছোট নদী আর পাঁক-কাদা মাখা রাস্তা। গাড়ি চলা মুশকিল। দুলকি চালে চলেছে গজরাজ।  পিঠে ইন্দিরা। তার পিছনে তাক করছে ফটোগ্রাফার রিপোর্টারদের দল।

দীর্ঘ যাত্রা শেষ করে বেলচি গ্রামে গজরাজ ঢুকল। গণহত্যার জমাট ভয়াল ছায়া একটু ফিকে হয়। ইন্দিরা নামলেন। ভয়ার্ত গ্রামবাসীরা নমস্কার জানিয়ে বললেন- আপনাকে ভোট দিইনি। ভুল করেছি। সেদিন পরাজিত ইন্দিরা বুঝলেন জয় নিকটে। বেলচির ভয়াবহ পরিস্থিতি ইন্দিরা গান্ধীর সফরের ধাক্কায় বিশ্বজুড়ে আলোচিত হতে থাকে। আর রাজনৈতিক দাবার চালে প্রতিপক্ষকে ঘিরতে থাকেন ইন্দিরা। জনতা সরকার শুধুমাত্র পতনের দিন গুণছিল।

বিহারের মাটিতে এরপর লড়াইটা হবে কংগ্রেস, তাদের প্রধান বিরোধী দুই কমিউনিস্ট পার্টি অর্থাৎ সিপিআই, সিপিআইএম, আর কিছু আঞ্চলিক দলের মধ্যে। তবে এর কিছু আগে পশ্চিমবঙ্গ থেকে রাজনৈতিকভাবে উৎখাত হয়ে নকশালপন্থী সংগঠনগুলি বিহারে নতুন করে জমি খুঁজে নিয়েছিল। ১৯৭৪ সালে তৈরি হওয়া নকশালপন্থীদের সংসদীয় রাজনৈতিক দল সিপিআই এম-এল (লিবারেশন) বিহার থেকেই নিজেদের রাজনৈতিক পথ তৈরি করতে থাকে।

তীব্র জাতিবাদ, জমির আন্দোলন আর ভোট কূটনীতির হরতন, রুইতনের বাদশা বনাম ইস্কাপনের বিবি নিয়ে বিহার এমনই।

ই দেখ্ মাদারি কা খেল। (চলবে)

গত পর্ব: Pataliputra: গান পয়েন্টে মুচকি হাসল জগদীশ, পর্দার আড়ালে কাঁপছিল পুলিশ সোর্স