অয়ন দে, উত্তরবঙ্গ: ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে চলমান উত্তেজনা ও বাণিজ্য সংক্রান্ত জটিলতার প্রেক্ষাপটে মঙ্গলবার সকালে ফুলবাড়ি সীমান্তে পৌঁছান রাষ্ট্রসংঘের (UN Delegation) একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল। প্রায় ৪০ জন সদস্যের এই প্রতিনিধি দল সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করেন এবং ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একটি বিশেষ বৈঠকে মিলিত হন। এই সফরকে প্রশাসনিক ও আন্তর্জাতিক মহলে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
সূত্রের খবর, বৈঠকে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত বাণিজ্য, নিরাপত্তা ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক পরিবহন ব্যবস্থা এবং চলমান অচলাবস্থা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হয়েছে। সম্প্রতি ভুটান থেকে পাথর বোঝাই লরি ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে বাংলাদেশে প্রবেশ করায় ভারতীয় লরি চালকরা তীব্র আপত্তি জানান। এর জেরে ফুলবাড়ি সীমান্তে বাণিজ্য ও পরিবহন কার্যক্রমে একপ্রকার অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। এই ঘটনা স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে এবং সীমান্ত এলাকায় উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। রাষ্ট্রসংঘের প্রতিনিধি দল এই সমস্যার সমাধানে মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
ফুলবাড়ি সীমান্ত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে বাকি ভারতকে সংযুক্ত করা সিলিগুড়ি করিডোরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই এলাকা ভারতের কৌশলগত দিক থেকেও অত্যন্ত সংবেদনশীল। সাম্প্রতিক সময়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য সংক্রান্ত বিধিনিষেধের কারণে স্থানীয় অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারত সরকার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের ফুলবাড়ি ও চ্যাংরাবান্ধা সীমান্ত চেকপোস্টের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে কিছু নির্দিষ্ট পণ্যের আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে হাজার হাজার ব্যবসায়ী ও শ্রমিকের জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে।
রাষ্ট্রসংঘের প্রতিনিধি দলের সফরে সীমান্তের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও গুরুত্ব পেয়েছে। সম্প্রতি ভারতের ‘অপারেশন সিন্দুর’-এর আওতায় ২,০০০-এরও বেশি অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীকে সীমান্তে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এই পদক্ষেপ বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিবি)-এর তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে, যারা এটিকে “অগ্রহণযোগ্য” বলে অভিহিত করেছে। এই ঘটনা দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক উত্তেজনা বাড়িয়েছে। রাষ্ট্রসংঘের প্রতিনিধি দল এই বিষয়ে উভয় পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে একটি সমাধানের পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে বলে জানা গেছে।
বৈঠকে আরও আলোচিত হয়েছে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে অবৈধ পণ্য চোরাচালান ও মানবপাচারের সমস্যা। ফুলবাড়ি সীমান্তে বিএসএফ সম্প্রতি বেশ কিছু চোরাচালানের প্রচেষ্টা ব্যর্থ করেছে, যার মধ্যে মোবাইল ফোন ও অন্যান্য নিষিদ্ধ পণ্যের চালান উল্লেখযোগ্য। এই ধরনের ঘটনা সীমান্তে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছে।
প্রতিনিধি দলের সফরের পর স্থানীয় প্রশাসন ও ব্যবসায়ী মহলের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছে। তারা মনে করছেন, রাষ্ট্রসংঘের মধ্যস্থতায় ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য ও পরিবহন সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে। তবে, এই সফরের ফলাফল এবং ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ নিয়ে এখনও বিস্তারিত কোনও তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। সীমান্ত এলাকার বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীরা এই আলোচনার ফলাফলের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন, যা তাদের জীবন ও জীবিকার উপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।
এই সফর ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। তবে, দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও কূটনৈতিক উদ্যোগ ছাড়া এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। রাষ্ট্রসংঘের এই পরিদর্শন সেই দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।