বখতিয়ারের ধ্বংস কার্য: এই বৌদ্ধ মঠে লুকিয়ে ভারতের বিরাট অংশের ইতিহাস

তিব্বতের বহু প্রাচীন একটি বৌদ্ধ মঠ “শাক্য মনাস্ট্রি”তে মেরামতের কাজ চলছিল। আচমকাই দেওয়ালের একটি অংশ ভেঙ্গে পড়ে এবং বেরিয়ে পড়ে সুবিশাল এক গোপন কক্ষ, যেখানে…

Buddhist temple

তিব্বতের বহু প্রাচীন একটি বৌদ্ধ মঠ “শাক্য মনাস্ট্রি”তে মেরামতের কাজ চলছিল। আচমকাই দেওয়ালের একটি অংশ ভেঙ্গে পড়ে এবং বেরিয়ে পড়ে সুবিশাল এক গোপন কক্ষ, যেখানে থরে-থরে সাজানো রয়েছে প্রাচীন পুঁথি। একটি-দুটি নয়, সর্বমোট ৮৪০০০ পুঁথি। পুঁথির বিষয়বস্তু দেখে ঐতিহাসিকদের চক্ষু চড়কগাছ। দেখা যায় এখানে সংরক্ষিত রয়েছে মানব সভ্যতার ১০০০ বছরের ইতিহাস। এখনও পর্যন্ত এই সুবিশাল সংগ্রহের মাত্র ৫% ডিকোড করে পাঠোদ্ধার করা হয়েছে।

ছবিতে সেই বিপুল সংগ্রহের একটি অংশ দেখা যাচ্ছে। এইরকম অমূল্য পুঁথির বিপুল সংগ্রহ ছিল ভারতবর্ষের প্রতিটি প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুধুমাত্র নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়েই ছিল ১০ লক্ষ পুঁথি, যা বখতিয়ার খিলজি ছয়মাস ধরে পুড়িয়ে শেষ করেছে। এগুলি যে কোনও গল্পকথা নয়, তার প্রমাণ তিব্বতের শাক্য মঠের এই গ্রন্থাগার। ভারতবর্ষের সেই বিপুল জ্ঞানভান্ডার যদি আজও অক্ষত থাকত, তবে প্রাচীন ঐতিহ্য ও জ্ঞানের উত্তরাধিকারী রূপে ভারত যে অন্যান্য দেশের তুলনায় সহস্র যোজন এগিয়ে থাকত একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।

কয়েক হাজার অক্ষরের বিন্যাসে লেখা ইতিহাসের বইটা যতটা নীরস লাগে, মূল ইতিহাস কিন্তু ততোটা রসহীন হয় না। প্রতিটি ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে থাকে অজস্র উত্থান-পতন, রক্তপাত, দুর্বিষহ বাস্তবতা। “বখতিয়ার খিলজী ১২০৪ সালে মাত্র ১৭ জন অশ্বারোহী সেনা নিয়ে নদীয়ার রাজা লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে বাংলা জয় করেন”- ইতিহাসের বইয়ের এই লাইনটি নিশ্চয় সবার ঝাড়া মুখস্ত রয়েছে? যদিও এর আগের বা পরের কোনো কিছুই আমাদের ঠিকমতো জানা নেই। চলুন জেনে নেয়া যাক সেই বখতিয়ার খিলজী আর তার দুর্ধর্ষ অভিযানের কথা।

খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতকের গোড়ার কথা। তখন বাংলায় রাজত্ব করতেন সেন বংশের রাজা লক্ষণ সেন। তিনি নদীয়ায় বাস করতেন। একদিন তার দরবারের পন্ডিতরা তাকে বললেন যে, তাদের প্রাচীন গ্রন্থে লিখিত আছে, বাংলা তুর্কীদের দখলে যাবে। ততদিনে সমগ্র উত্তর ভারত তুর্কীরা অধিকার করেছে এবং বখতিয়ার খিলজী বিহার জয় করেছেন।

রাজা ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের কাছে জানতে চাইলেন প্রাচীন গ্রন্থে বাংলা আক্রমণকারীর দেহাবয়ব সম্পর্কে কোনো ইঙ্গিত আছে কিনা। জবাবে পন্ডিতগণ জানান, যে তুর্কী বাংলা জয় করবেন, তিনি আকৃতিতে খাটো এবং দেখতে কুৎসিত হবেন, তার হাতগুলো হাঁটু পর্যন্ত লম্বা হবে। বিশ্বস্ত লোক পাঠিয়ে রাজা লক্ষণ সেন নিশ্চিত হন যে, বিহারজয়ী বখতিয়ার খিলজীর সাথে উক্ত বিবরণগুলি মিলে যায়। তুর্কী আক্রমণ এক প্রকার অত্যাসন্ন বুঝেও লক্ষণ সেন তা আমলে নেন নি। ব্রাহ্মণ পন্ডিতগণ রাজার অনুমতি ছাড়াই নদীয়া ছেড়ে চলে যান।

ঐতিহাসিক মিনহাজ-ই-সিরাজ তার ‘তবকাত-ই-নাসিরি’ গ্রন্থে উপরোক্ত তথ্যটি প্রকাশ করেন। ঘটনাটি সত্যিই ঘটেছিলো কিনা তা জোর দিয়ে বলার উপায় নেই। কিন্তু তার অনতিকাল পরেই বখতিয়ার খিলজী নদীয়া আক্রমণ করেন এবং বাংলায় মুসলিম শাসন সাম্রাজ্য স্থাপন করেন।

উপমহাদেশে মুসলিম সাম্রাজ্য বিস্তারের তিনটি স্তর দেখা যায়। প্রথমত, আরবগণ মুহাম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে ৭১২ খ্রিস্টাব্দে সিন্ধু ও মুলতান জয় করে। দ্বিতীয় পর্যায়ে তুর্কী সুলতান আমীর সবুক্তগীন ও তার পুত্র সুলতান মাহমুদ দশম শতাব্দীর শেষ দিকে বারবার উপমহাদেশ আক্রমণ করে লাহোর পরিবেষ্টিত এলাকা স্বীয় গজনী রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। তৃতীয় পর্যায়েও তুর্কীরাই আক্রমণ পরিচালনা করে। এইবার নেতৃত্ব দেন মুহাম্মদ ঘুরী। এবারের আক্রমণে তুর্কীরা দিল্লীকে কেন্দ্র করে উপমহাদেশে স্থায়ী মুসলিম সাম্যাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। বখতিয়ার খিলজীর বাংলা আক্রমণ এই তৃতীয় পর্যায়ের আক্রমণেরই অংশ।

ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী আফগানিস্তানের গরমশির এলাকার অধিবাসী ছিলেন। তিনি তুর্কীদের খিলজী সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। তার বাল্যজীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তবে মনে করা হয় যে, তিনি দারিদ্রের নিষ্পেষণে স্বদেশ পরিত্যাগ করে জীবিকার সন্ধানে বের হন। মুহাম্মদ ঘুরী তখন ভারতীয় উপমহাদেশে অভিযান চালাচ্ছিলেন। বখতিয়ার, ঘুরীর সৈন্যদলে চাকুরীপ্রার্থী হয়ে ব্যর্থ হন। তখন নিয়ম ছিলো, প্রত্যেক সৈন্যকে নিজ ঘোড়া ও যুদ্ধাস্ত্রের ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হতো। সামর্থ্যের অভাবে বখতিয়ার ঘোড়া বা ঢাল-তলোয়ার কিছুই যোগাড় করতে পারেননি। তাছাড়া খাটো দেহ, লম্বা হাত ও কুৎসিত চেহারার বখতিয়ার খিলজী সেনাধক্ষ্যের দৃষ্টিও আকর্ষণ করতে পারেননি।

গজনীতে ব্যর্থ হয়ে বখতিয়ার দিল্লীর সম্রাট কুতুবউদ্দিন আইবেকের কাছে আসেন এবং সেখানেও ব্যর্থ হন। অতঃপর বখতিয়ার পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে বদাউনে গিয়ে পৌঁছেন। বদাউনের শাসনকর্তা মালিক হিজবর-উদ-দীন তাকে নগদ বেতনে চাকুরীতে রাখেন, তবে এমন চাকুরীতে বখতিয়ার সন্তুষ্ট ছিলেন না। কিছুদিন কাজ করার পর তিনি অযোধ্যায় চলে যান। অযোধ্যার শাসক হুসাম-উদ-দীন বখতিয়ারের প্রতিভা অনুধাবন করেন এবং তাকে ভিউলী ও ভগত নামে দু’টি পরগনার জায়গীর প্রদান করে মুসলিম রাজ্যের পূর্বসীমান্তে সীমান্তরক্ষীর কাজে নিযুক্ত করেন। এখানে বখতিয়ার তার ভবিষ্যৎ উন্নতির সম্ভাবনা দেখতে পান।

রাজা লক্ষণ সেনের রাজধানী ছিল ঢাকার বিক্রমপুরে। তিনি বৃদ্ধ বয়সে গঙ্গাপাড়ের পবিত্র তীর্থস্থান নদীয়ায় বাস করছিলেন। তিনি একজন সাহসী যোদ্ধা এবং সুশাসক ছিলেন। নিজ রাজ্য রক্ষার কোনো পূর্ব প্রস্তুতি তিনি নেন নি এমনটা ধরা যায় না। ঐতিহাসিকগণ মনে করেন, তিনি রাজ্যের মূল প্রবেশপথ তেলিয়াগড় গিরিপথে প্রহরার ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু সুকৌশলী বখতিয়ার খিলজী সেই পথে না গিয়ে দক্ষিণ দিকের জঙ্গলাকীর্ণ এলাকা ঝাড়খন্ডের মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হন।