Pataliputra: রাজপুতদের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে হরিজনদের চোখ জ্বলছিল, প্রত্যাঘাতে জন্মাল রণবীর সেনা

প্রসেনজিৎ চৌধুরী: ভাগলপুর গণহত্যার বিকট চেহারা দেখে দেশ শিহরিত হয়েছিল। এ ছিল নেহাতই ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতির ফল। কিন্তু বিহারের রাজনৈতিক ইতিহাসে (Pataliputra) যে সামন্তবাদী শক্তি…

প্রসেনজিৎ চৌধুরী: ভাগলপুর গণহত্যার বিকট চেহারা দেখে দেশ শিহরিত হয়েছিল। এ ছিল নেহাতই ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতির ফল। কিন্তু বিহারের রাজনৈতিক ইতিহাসে (Pataliputra) যে সামন্তবাদী শক্তি জমিয়ে বসে আছে, তার বিরুদ্ধে চলা সংঘর্ষের খতিয়ানে চোখ রাখুন দেখবেন বদলা রাজনীতির মারাত্মক চেহারা। পুরো আশি-নব্বই দশকের এই সময়ে গ্রামের পর গ্রাম অাচমকা হামলায় উজাড় হয়েছে। কোথাও রাজপুত, ব্রাহ্মণদের বাহিনী কেড়েছিল নিচু জাতের জীবন। কোথাও নিচু জাতের হয়ে বদলা নিয়েছিল অতিবামপন্থী সশস্ত্র সংগঠন এমসিসি ও জনযুদ্ধ গোষ্ঠি।

বিহারের এমন ধরণের গণহত্যার তথ্য নিয়ে নিরন্তর গবেষণা বলে দিচ্ছে, শুধুমাত্র আশির দশক জুড়ে বিহারে প্রতিবছর এক বা একাধিক গণহত্যা সংঘটিত হয়। এই গণহত্যার রাজনীতিতে  সর্বাধিক আলোচিত ১৯৮৬ সালে জেহানাবাদের আরওয়ালে ২৪ জন অতিবাম সংগঠনের কৃষক সমর্থকদের খুন। ঠিক পরের বছর হয়ে গেল মারাত্মক ঘটনা। ঔরঙ্গাবাদ জেলার দালেলচকে একসঙ্গে ৫২ জন উচ্চবর্ণকে খুন করা হতেই দেশ ফের নড়ে গেল। দুই উচ্চবর্ণের মধ্যে রেষারেষির কারণে এই খুন সংঘটিত হয়। পুরো আশির দশকের গণহত্যার এই পর্বগুলির পেরিয়ে ১৯৮৯ সালের ভাগলপুর গোষ্ঠি সংঘর্ষ শুধু দেশ নয় বিশ্বকে শিহরিত করেছিল।

   

ঘাতকের মুখোশ পরে মৃত্যু আসে নীরবে। জীবনের উপর থুথু ফেলে চলে যায়।

নগরে অবিশ্রান্ত মানুষের মিছিল একে অন্যকে ধাক্কা মেরে চলেছে। সবই স্বাভাবিক। তবে এর সঙ্গেই রয়েছে অস্বাভাবিক চোখের ইশারা। নিঃশব্দে ছুরি হাতে ঘাতক ঠিক ঘাড়ের কাছে গরম নিঃশ্বাস ফেলে। চমকে ওঠে শিকার। হয়ত পালানোর চেষ্টা করে। যে পারল না তার রক্তাক্ত দেহ পড়ে থাকল। কখনো গুলির পর গুলি চলে। জনতার ভিড়ে মিশে যায় আততায়ী। এই ভিড়ে ঠাসা মানুষের জঙ্গল ভয়ঙ্কর।

এভাবেই অপরাধকে রোজগার বানানোর খেলা চলছিল বিহারে। জামায় রক্তাক্ত হাত মুছে খৈনি মুখে দিয়ে হাসতে থাকে শিকারি। এ দৃশ্য নিয়মিত মুঙ্গের,পূর্ণিয়া, গয়া, বেগুসরাই, ভোজপুর, জেহানাবাদ, আরা, সিওয়ান, খাগাড়িয়া, সাসারাম,  ধানবাদ, ঝরিয়া, গিরিডিতে। নব্বই দশকে ‘জঙ্গলরাজ’ শুরু হয়েছিল বিহারে। কোথাও রাজনৈতিক বদলা পর্ব, কোথাও অপরাধকে রোজগার বানিয়ে একটার পর একটা মারাত্মক ঘটনায় চমকে যাচ্ছিল দেশ।
कौन सफ़ेद है यहाँ- লালুপ্রসাদ যাদব
বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে জঙ্গলরাজ বিতর্কে বিভিন্ন সময় সমালোচিত হয়েছেন লালুপ্রসাদ যাদব। ‘আনোখা আন্দাজ’ বয়ানে জবাবও দিয়েছেন ‘কেউ সাদা না’। এমন মন্তব্যের পিছনে আছে তীব্র শ্লেষ। গঙ্গার দুই পারের জনগণ এর সাক্ষী। রক্তাক্ত সময় পার করছিল ভারতীয় গণতন্ত্রের গর্ভগৃহ বিহার।

শীতের দিন ঝুপ করে শেষ হয়েছে। কনকনে ঠাণ্ডায় গরম চায়ের আসরে কেউ ফিসফিসিয়ে বলল ‘উহ লোগ আয়ে থে…’। ভয় ছড়িয়ে গেল। সেই আসরে চাদরে মুখ ঢেকে সব শুনে ছায়ার মতো সরে পড়ে আর কয়েকজন।  গয়া জেলার বারা গ্রামের বড় পিপল (অশ্বত্থ) গাছের নিচে জমা হয়েছে সেই ছায়ামানুষরা। প্রত্যেকের হাতে বন্দুক। এদের লক্ষ্য গ্রামের ভূমিহার রাজপুত গোষ্ঠী। হামলাকারীরা এসেছে বদলা নিতে। ১৯৯২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি হরিজন সম্প্রদায়ের এই বদলা দেখে ভয়ে কুঁকড়ে গেছিল বিহার-গোটা দেশ।

গ্রামের সামনে নালা। এর দু’দিকে কিছুটা মাঠের মতো। সেখানে সার সার বসে আছে যারা, তাদের কারোর সঙ্গেই চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস নেই হরিজনদের। দিনের বেলায় অন্তত তিন হাত দূর থেকে কথা বলতে হবে। যদি ছায়ার সঙ্গে স্পর্শ হয় তাহলে শুরু হয় মার। রাজপুত জাতের মার খেতে অভ্যস্ত হরিজন। অবশ্য হরিজনদের মেয়েরা কোনোদিনই অস্পৃশ্য নয়। সেই উঁচু রাজপুতরা এবার হাঁটু গেড়ে বসে আছে। মাথার পিছনে হরিজনদের বন্দুকের নল। গ্রাম জুড়ে বিলাপ। ঘরে ঘরে চুড়ি ভাঙা চলছে। কান্নার শব্দ ভেসে আসছিল।

লো বদলা…। একসঙ্গে হাত চলল। যে রাজপুতের ছায়া স্পর্শ করলে ‘পাপ’ হয় হরিজনদের। তাদেরই হাতের ছুরি পরপর বসে গেল উঁচু জাতের গলায়, ঘাড়ে। চলল গুলি। বারা গ্রামের ভিতর থেকে আরো জোরে ভেসে এলো কান্না। পরপর পড়ে থাকল চল্লিশ জনের দেহ।  উঁচু জাতের রক্তে পা দিয়ে নিচু জাতের হরিজন বলে-বদলা। তাদের হয়ে এমসিসি-মাওয়েস্ট কমিউনিস্ট সেন্টার আবার চোখে চোখ রেখে বদলা নিয়েছে। হরিজনদের একটার পর একটা গ্রামে ঢুকে ভূমিহারদের পরপর খুন, ধর্ষণের এটাই ছিল প্রত্যুত্তর।

বারা গ্রামের গণহত্যায় বিহার ও কেন্দ্র সরকার প্রবল আলোড়িত। পুলিশ আসে। তদন্ত শুরু হয়। অফিসার দেখেন ঘরে ঘরে মৃতদেহ আঁকড়ে জ্বলছে চোখ। নিয়ম মাফিক প্রশ্ন করেন তিনি- কিসিকো প্যাহচানা? উত্তর আসে- জি নেহি। বদলা লেঙ্গে।

বারা গ্রামের এই গণহত্যা বিহারের মাটিতে অতিবামপন্থী সংগঠনগুলির বিভিন্ন শাখার মধ্যেও চাঞ্চল্য ফেলে দেয়। তিনটি প্রধান অতি বাম সংগঠন সিপিআই(এম-এল), পার্টি ইউনিটি ও এমসিসি  পরস্পরের মধ্যে রাজনৈতিক সংঘর্ষে জড়াচ্ছিল। এদিকে খবর আসছিল রাজপুত ভূমিহার ব্রাহ্মণদের সশস্ত্র বাহিনি তৈরি হচ্ছে। ফলে অতি বাম সংগঠনগুলি চিন্তা করতে থাকে পরবর্তী জোট কৌশল। এর ফলে জাতিবাদ ভিত্তিক সংঘর্ষ বিশেষ মোড় নিচ্ছিল বিহারে। উঁচু জাতের নিজস্ব বাহিনী রণবীর সেনা এই পর্বের আরো এক ভয়ানক নাম। এর মুখিয়া এক শীর্ণকায় ‘মাস্টারজি’- ব্রহ্মেশ্বর সিং।  (চলবে)

গত পর্ব: Pataliputra: ‘হালাত গম্ভীর হ্যায়…’ ভাগলপুর রক্তাক্ত বুঝেও নীরব ছিল কংগ্রেস, যেন অযোধ্যার ওয়ার্ম আপ