Pataliputra: ‘হালাত গম্ভীর হ্যায়…’ ভাগলপুর রক্তাক্ত বুঝেও নীরব ছিল কংগ্রেস, যেন অযোধ্যার ওয়ার্ম আপ

প্রসেনজিৎ চৌধুরী: ধানবাদের রায়বাবুর ভোট ক্যারিশ্মা ‘লাল আগুন’ শেষ হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। এই বছরেই বিহার (Patliputra) রক্তাক্ত হয়েছিল ভয়াবহ ধর্মীয় সংঘর্ষে-ভাগলপুর গণহত্যা। দু’মাসের টানা রক্তাক্ত…

প্রসেনজিৎ চৌধুরী:
ধানবাদের রায়বাবুর ভোট ক্যারিশ্মা ‘লাল আগুন’ শেষ হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। এই বছরেই বিহার (Patliputra) রক্তাক্ত হয়েছিল ভয়াবহ ধর্মীয় সংঘর্ষে-ভাগলপুর গণহত্যা। দু’মাসের টানা রক্তাক্ত পরিস্থিতি, সেনা টহলে গঙ্গা তীরে বাঙালির প্রিয় ‘পশ্চিম’ রক্ত স্নান করেছিল।

“विस्तार है अपार, प्रजा दोनों पार –करे हाहाकार निःशब्द सदा-ओ गंगा तुम –ओ गंगा बहती हो क्यूँ?”-শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়

   

ভাগলপুর
শ্রীকান্ত-ইন্দ্রনাথের দুরন্তপনার শহর, কালীদাসীর (চন্দ্রমুখী?) ঠুংরির শব্দে ঘুম ভেঙে হাই তোলা যে জনপদ ভাগলপুর শরৎচন্দ্রকে মুগ্ধ করেছিল-সেই শহর ‘৮৯ তে ভয়াবহ। স্বাধীনোত্তর ভারতে গুজব ছড়িয়ে ধর্মনিরপেক্ষতাকেই গঙ্গার জলে চুবিয়ে মেরে ভাগলপুরে হলো সংঘর্ষ। উত্তরপ্রদেশ থেকে রাজনৈতিক ইন্ধন ছিলই। আর বিহার সরকারের নড়বড়ে পরিস্থিতি তৈরি করেছিল অরজাকতা। হাজার খানেক মানুষের মৃতদেহের গন্ধে শকুনের ওড়াউড়ি, ভাগলপুর তখন ভাগাড়। এ দৃশ্য যারা দেখেছেন তারা অনেকেই ভয়ে মুখ খুলতে পারেন না। ভাগলপুর জুড়ে মৃতদেহ পচে ফুলে উঠেছিল। ভয়াবহ পরিস্থিতি। রাস্তায় রাস্তায় সশস্ত্র বাহিনীর টহলদারি চলছে। ‘ভাগলপুর দাঙ্গা’ কুখ্যাত হয়ে আছে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে। ভাগলপুর বরাবর বাঙালিদের বড় পছন্দের।

খুব টেনশন চলছে। যখন তখন কিছু হয়ে যেতে পারে। বার বার বিহার সরকারকে সতর্ক করেছিলেন ভাগলপুরের জেলাশাসক অরুণ ঝা। একদিকে রামজন্মভূমির শিলাপূজা ঘিরে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের উন্মাদনা। অন্যদিকে স্থানীয় মুসলিমদের একরোখা মনোভাব। চলছিল দুপক্ষের উত্তেজিত স্লোগান। ১৯৮৯ সালের ২৪ অক্টোবর তারিখটা ভয়াবহ হয়ে গেল ধর্মীয় উন্মাদনার কারণে। জেলা প্রশাসনের এত ক্ষমতা ছিল না, উত্তেজিত দুপক্ষকে সামলানোর। পাটনা প্রায় নীরব। আর ভাগলপুর কাঁপছিল অজানা ভয়ে। জেলাশাসক বুঝলেন পরিস্থিতি হাতের বাইরে যাচ্ছে। পরপর খুন হচ্ছে এমন গুজবের পর শুরু হয়ে গেল হামলা। ভাগলপুরের রাস্তায় রাস্তায়, সংখ্যালঘু মহল্লায় ভয়াবহ হামলার পরের দৃশ্যগুলো কেমন ছিল তা আগেই উল্লেখ করেছি। সরকারি হিসেবে ‘ভাগলপুর দাঙ্গা’-তে নিহতের সংখ্যা এক হাজারের বেশি। নিহতদের অধিকাংশ সংখ্যালঘু।

ভাগলপুর দাঙ্গা থামানোর বদলে বিহারের তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের নীরবতা বারবার বিতর্ক তৈরি করেছে। এই ঘটনার পর আরও একবার ‘নীরব’ থেকেছিল কংগ্রেস; ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর উত্তরপ্রদেশে বাবরি মসজিদ ধংসের দিন। সেদিন করসেবকদের হাতে লজ্জাজনক ধংসের মুহূর্তে বিশেষ পূজা করছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাও। ভাগলপুরে প্রশাসনিক নীরবতা যেন কংগ্রেসের কাছে অযোধ্যার ঘটনার ওয়ার্ম আপ !

ভাগলপুর সংঘর্ষের পরেই বিহারের সরকার পরিবর্তন  দ্রুত হয়। নব্বইয়ের ভোটে বিহার প্রদেশ কংগ্রেসে সর্বশেষ মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে অন্তরালে চলে গেলেন জগন্নাথ মিশ্র। ১৯৯০ সালে বিহার সেই যে ঢুকে গেল কংগ্রেসহীন সরকারের রাজত্বে, গত দু’দশকের মাঝে নতুন শতাব্দী এসেছে কিন্তু কংগ্রেস আসেনি বিহারে। জনতা দল সরকার গড়ল। বিহারের মসনদে এলেন ‘রঙিন আদমি’ লালুপ্রসাদ যাদব।

বাড়িটার নাম ১-অ্যান্নে মার্গ। ভিতরে বড় আমগাছের ছায়ায় দড়ির খাটিয়া পাতা। রেডিও-তে জোরে জোরে ভোজপুরি গান বাজে। লালু-রাবড়ির সুখের সংসারে কলকল করে ভবিষ্যৎ যদুবংশের কূলতিলকরা। বাড়িটা মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন। ছায়া ঘেরা চারিদিক। মাঝে মধ্যে দুধেল ভাগলপুরি গাইয়ের মধুর হাম্বা ডাক শোনা যায়। মুখ্যমন্ত্রী  লালুপ্রসাদ ভাবেন নতুন দল তৈরির কথা।

জেপি শিষ্য তিনমূর্তি লালুপ্রসাদ যাদব, নীতীশ কুমার,রামবিলাস পাসোয়ান যে যার নিজের পথ বাছতে দিনরাত এক করছেন। পাটনার সচিবালয় থেকে অ্যান্নে মার্গের অন্দরমহলে গুজগুজ চলছিল-জনতা পার্টি ওই ভাগলপুরে গঙ্গার পাড় ভাঙার মতো ধসে পড়বে। শুরুটা করলেন নীতীশকুমার। পঁচাত্তরের জরুরি অবস্থায় জেপির অন্যতম সহযোদ্ধা জর্জ ফার্নান্ডেজ। তাঁর সঙ্গেই সমতা পার্টির সূচনা করলেন নীতীশ, ১৯৯৪ সালে। আর ১৯৯৭ তে লালুপ্রসাদ বানিয়ে নিলেন রাষ্ট্রীয় জনতা দল। তবে আপাতত রামবিলাস জনতা দলেই থাকলেন। তিনি পরে লোকজনশক্তি পার্টি তৈরি করেন। তবে ততকালীন সময়ের এই রাজনৈতিক ঘূর্ণনে ঝড়ের মতো ছড়িয়ে পড়ছিল দুটি নাম-বিনোদ মিশ্র এবং ব্রহ্মেশ্বর সিং। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী। বন্দুকের বদলে বন্দুকের নীতিতে বিশ্বাসী দু’জনই।

‘৯০দশক মানেই রক্তাক্ত বিহারের এমন সব কথা, যেখানে মিশে আছে যন্ত্রণা, স্বজন হারানোর বেদনা আর বদলা নেওয়ার রোখ।  ব্রাহ্মণ ভূমিহার রাজপুতদের সঙ্গে টানা সংঘর্ষে যাদব, কাহার, দুসাদ। উঁচু নিচু জাতের মারকাটারি লড়াই। কিন্তু তার আগে পুরো ‘৮০ দশক জুড়ে বিহারের মাটিতে জমিদার বনাম অতি বাম সংগঠন এমসিসি, জনযুদ্ধ সংঘর্ষের রক্তাক্ত খতিয়ান বারবার দেশকে নড়িয়ে দিয়েছে।গয়া,পাটনা,ঔরঙ্গাবাদ, ভোজপুর তথা মধ্য বিহারের জমিতে মিশে আছে একটার পর একটা এমন ঘটনার কথা।

নেপালের প্রান্তসীমা ধরে পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম দিক ঘেঁষে গঙ্গা ও শোন নদীর দু’দিকে বিস্তির্ণ কৃষি জমির আল পেরিয়ে রুক্ষু ভোজপুর ঘুরে পূবে আরা জগদীশপুর গয়া জুড়ে প্রচলিত শব্দ-‘দেখেঙ্গে শালো’। হাজারিবাগ পেরিয়ে আরো দক্ষিণে শাল শিমূলের পাতায় পাতায় বিছিয়ে থাকা পাথুরে জমি টিলার জঙ্গলে,জঙ্গলে মশালের আলোয় বাংলা হিন্দি মেশানো টানাটানা সুরে মেঠো গান হয়-
…উহুঁ উহুঁ উহুঁ না…উহ তো নকশালেরই ছানা…।(চলবে)

গত পর্ব:Pataliputra: মাফিয়া সূরজদেও সিংয়ের ইশারায় চলল গুলি, মার্কসিস্ট রায়বাবু নামলেন গণপ্রতিরোধে