ভারতে ব্যবসা করতে এসেছিলেন ব্রিটিশরা (India UK Business)। কৌশলে রাজত্ব করতে শুরু করেন। এবার ইংরেজদের দেশে ভারতের সার্জিক্যাল স্ট্রাইক। টেমসের পাড়ে দাপট দেখাচ্ছেন ভারতীয় ব্যবসায়ীরা।
স্বাধীনতার ৭৭ বছর পরে ভারত আজ আর সেই উপনিবেশীয় অতীতের ছায়ায় থাকা দেশ নয়। এখন ভারত বিশ্বের অর্থনৈতিক মঞ্চে একটি শক্তিশালী অংশীদার হিসেবে উঠে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে যুক্তরাজ্যের মতো ঐতিহাসিকভাবে শক্তিশালী অর্থনৈতিক কেন্দ্রে ভারতীয় কোম্পানিগুলো এখন তাদের দাপট দেখিয়ে চলেছে। ২০২৪ সালে ভারতীয় মালিকানাধীন কোম্পানিগুলো যুক্তরাজ্যে মোট ৯১.৬২ বিলিয়ন ডলার রাজস্ব উৎপাদন করেছে, যা একটি অবাক করা পরিসংখ্যান। এই সংখ্যাটি প্রমাণ করে যে, ভারত আজ সত্যিই আন্তর্জাতিক ব্যবসা জগতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
ইতিহাসের পটভূমি: উল্টো গতি
১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধ থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা অবধি ব্রিটিশরা ভারতে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দখল বিস্তার করেছিল। পূর্ব ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে তাদের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য ছড়িয়ে পড়েছিল এবং ভারতকে একটি উৎপাদনশীল উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হত। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে ভারত ধীরে ধীরে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শুরু করে। আজকের দিনে সেই ভারত যে দেশে ব্রিটিশরা শাসন করত, তার বাজারে এখন ভারতীয় ব্যবসায়ীরা তাদের প্রভাব বিস্তার করছে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক উল্টো গতির প্রমাণ।
২০২৪ সালে যুক্তরাজ্যে ১,১৯৭টি ভারতীয় মালিকানাধীন কোম্পানি কার্যক্রম চালাচ্ছে, যা গত বছরের তুলনায় ২৩% বৃদ্ধি নির্দেশ করে। এই কোম্পানিগুলো মোট ১২৬,৭২০ জনকে চাকরি দিয়েছে, যা যুক্তরাজ্যের স্থানীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় একটি উল্লেখযোগ্য অবদান। গ্রান্ট থর্নটনের একটি রিপোর্ট অনুসারে, এই কোম্পানিগুলোর গড় বার্ষিক রাজস্ব বৃদ্ধি প্রায় ৫০% হয়েছে, যা ব্রিটিশ বাজারে ভারতীয় প্রভাবের গভীরতা প্রকাশ করে।
বিভিন্ন খাতে বিস্তৃত প্রভাব
ভারতীয় কোম্পানিগুলো যুক্তরাজ্যে বিভিন্ন খাতে তাদের উপস্থিতি জানিয়েছে। প্রযুক্তি, ফার্মাসিউটিক্যাল, ম্যানুফ্যাকচারিং, অটোমোটিভ এবং পরিষেবা খাতে এই কোম্পানিগুলো তাদের দক্ষতা প্রদর্শন করছে। বিশেষ করে লন্ডনের মতো ব্যবসায়িক কেন্দ্রে ৫০% ভারতীয় কোম্পানি কার্যক্রম চালাচ্ছে, যা প্রযুক্তি, মিডিয়া এবং টেলিঅনুষ্ঠান (টিএমটি) খাতে সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। গ্রান্ট থর্নটনের ট্র্যাকার অনুসারে, দক্ষিণ যুক্তরাজ্যে ১৮% এবং উত্তরে ১৬% কোম্পানি দ্রুত বৃদ্ধি লাভ করছে।
এই বৃদ্ধির পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো ব্রেকজিট পরবর্তী যুক্তরাজ্যের ব্যবসায়িক পুনর্গঠন। ভারত এবং যুক্তরাজ্যের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) নিয়ে ২০২২ সাল থেকে আলোচনা চলছে, এবং ২০২৫ সালের ৬ মে একটি আদর্শ চুক্তি স্থির হয়েছে। এই চুক্তি ভারতীয় কোম্পানিগুলোর জন্য যুক্তরাজ্যে বিনিয়োগের পথ সহজ করেছে। ফলে, ভারতীয় প্রযুক্তি ও ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো যুক্তরাজ্যের বাজারে নতুন নতুন সুযোগ খুঁজে পাচ্ছে।
অর্থনৈতিক সংযোগ ও চাকরির সৃষ্টি
ভারতীয় কোম্পানিগুলো যুক্তরাজ্যে শুধু রাজস্ব উৎপাদন করছে না, বরং স্থানীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করছে। গত বছরের তুলনায় ৮,০০০-এরও বেশি নতুন চাকরি সৃষ্টি হয়েছে, যা যুক্তরাজ্যের শ্রমবাজারে একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে মধ্যম ও উত্তর পশ্চিম অঞ্চলে এই কোম্পানিগুলো উদ্ভাবন, গবেষণা ও উন্নয়ন (আর অ্যান্ড ডি) খাতে বিনিয়োগ করছে, যা স্থানীয় সম্প্রদায়ের জন্য উপকারী।
এই অর্থনৈতিক সংযোগ দুই দেশের মধ্যে গভীর সম্পর্কের প্রতীক। ২০২৩ সালে ভারত থেকে প্রায় ২৫০,০০০ মানুষ যুক্তরাজ্যে চলে এসেছে, যা স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক যত্ন খাতে তাদের অবদানকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। রিশি সুনাকের মতো ব্রিটিশ আসামী প্রধানমন্ত্রী হওয়া এবং বিরোধী দলের নেতা হিসেবে তাঁর ভূমিকা এই সম্পর্কের একটি উল্লেখযোগ্য দিক।
চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
তবে এই সফলতার পথে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। ভারতীয় কোম্পানিগুলোর জন্য যুক্তরাজ্যের জটিল নিয়মকানুন এবং বাজার প্রতিযোগিতা একটি বড় বাধা হতে পারে। তাছাড়া, ব্রেকজিটের পর যুক্তরাজ্যের অর্থনৈতিক নীতিগুলোতে পরিবর্তন আসছে, যা ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য নতুন সংযোজন আনতে পারে।
তবে সম্ভাবনা অসীম। যুক্তরাজ্যের সাথে ভারতের বাণিজ্য ২০৩০ সালের মধ্যে দ্বিগুণ করার লক্ষ্য রয়েছে। প্রযুক্তি, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষা খাতে আরও বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে। ভারতীয় যুবক-যুবতীদের জন্য যুক্তরাজ্যে দুই বছরের কাজের সুযোগ দেওয়ার পরিকল্পনা এই সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করবে।
স্বাধীনতার ৭৭ বছর পর ভারত টেমসের পাড়ে তার দাপট দেখিয়ে একটি নতুন ইতিহাস রচনা করছে। এটি শুধু অর্থনৈতিক সফলতা নয়, বরং একটি ঐতিহাসিক বিজয়ের প্রতীক। ভারতীয় ব্যবসায়ীদের এই ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ যুক্তরাজ্যের বাজারে ভারতের শক্তি ও প্রতিভার পরিচয় দিয়েছে। ভবিষ্যতে এই সম্পর্ক আরও গভীর হবে, যা দুই দেশের জনগণের জন্য উভয়প্রকার উপকার আনবে।