Urban relationships Kolkata: কলকাতা ‘আনন্দের শহর’ হিসেবে পরিচিত, শুধুমাত্র তার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির জন্য নয়, বরং সম্পর্কের নতুন গতিপথ সৃষ্টির জন্যও আলোচনায় রয়েছে। ২০২৫ সালে কলকাতার দম্পতিরা শহুরে সম্পর্কের ধারণাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছে। ঐতিহ্যবাহী বিবাহ, লিভ-ইন সম্পর্ক, পলিঅ্যামরি এবং প্রযুক্তির সাহায্যে সম্পর্কের নতুন মাত্রা—এই শহরের তরুণ দম্পতিরা সমাজের প্রচলিত নিয়ম ভেঙে নিজেদের পথ তৈরি করছে। এই পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে সামাজিক উদারতা, প্রযুক্তির প্রভাব এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার প্রতি ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব।
প্রযুক্তির ভূমিকা: সম্পর্কের নতুন সঙ্গী
কলকাতার দম্পতিরা ডিজিটাল যুগে সম্পর্ককে আরও গভীর করতে প্রযুক্তির উপর নির্ভর করছে। ২০২৫ সালে ভারতের প্রথম সম্পর্ক-কেন্দ্রিক অ্যাপ ‘সুপারকাপল’ চালু হয়েছে, যা দম্পতিদের মধ্যে যোগাযোগ উন্নত করতে এবং মানসিক বন্ধন শক্তিশালী করতে সাহায্য করছে। এই অ্যাপটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ব্যবহার করে দম্পতিদের জন্য ব্যক্তিগত চ্যাট, গেমিফাইড টাস্ক, এবং ভয়েস জার্নালিংয়ের মতো ফিচার সরবরাহ করে। এটি কোনো থেরাপি অ্যাপ নয়, বরং একটি লাইফস্টাইল প্ল্যাটফর্ম, যা দম্পতিদের দৈনন্দিন জীবনে মজাদার এবং অর্থপূর্ণ মুহূর্ত তৈরি করতে উৎসাহিত করে। সুপারকাপলের প্রতিষ্ঠাতা শঙ্কর বলেন, “আমরা থেরাপি প্রতিস্থাপন করছি না, বরং সম্পর্কের মানসিক দূরত্ব কমাতে সাহায্য করছি।” ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ সাইকিয়াট্রির তথ্য অনুসারে, শহরের ৩৫% দম্পতি মানসিক দূরত্বের সমস্যায় ভুগছেন, এবং গুগল ট্রেন্ডসে গত পাঁচ বছরে সম্পর্ক-সংক্রান্ত সহায়তার জন্য অনুসন্ধান ২০০% বেড়েছে।
লিভ-ইন সম্পর্ক: নতুন স্বাধীনতার প্রতীক
কলকাতায় লিভ-ইন সম্পর্কের প্রতি গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। যদিও এটি এখনও রক্ষণশীল সমাজে কিছুটা নিষিদ্ধ, তরুণ প্রজন্ম বিবাহের ঐতিহ্যবাহী ধারণার পরিবর্তে লিভ-ইন সম্পর্ক বেছে নিচ্ছে। সুপ্রিম কোর্ট ২০১৩ সালে বলেছে, দীর্ঘদিন ধরে একসঙ্গে থাকা দম্পতিদের আইনত বিবাহিত হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে, এবং তাদের ঘরোয়া সহিংসতা আইন, ২০০৫-এর অধীনে সুরক্ষা দেওয়া যায়। কলকাতার নিউটাউন, রাজারহাট, এবং সল্টলেকের মতো এলাকায় লিভ-ইন দম্পতিরা তাদের জন্য উপযুক্ত আবাসন খুঁজে পাচ্ছেন, যদিও কিছু কো-অপারেটিভ অ্যাপার্টমেন্ট এখনও রক্ষণশীল নীতি মেনে চলে। উদাহরণস্বরূপ, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার রশ্মি (ছদ্মনাম) বলেন, “আমরা বিবাহের বাইরে সম্পর্কে থাকতে চাই, কিন্তু আমাদের প্রেম এবং পারস্পরিক সম্মান অটুট।”
পলিঅ্যামরি: সম্পর্কের নতুন মাত্রা
কলকাতায় পলিঅ্যামরি বা একাধিক রোমান্টিক সম্পর্কের ধারণাও ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হচ্ছে। যদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক অমিতেশ মুখোপাধ্যায় বলেন, “পলিঅ্যামরি সমাজের প্রচলিত নিয়মের বিরুদ্ধে গিয়ে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার প্রতিনিধিত্ব করে।” ২০১২ সালে কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত ‘থ্রি অন এ বেড’ নামক শর্ট ফিল্মটি এই বিষয়ে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছিল। এটি দেখিয়েছে যে, কলকাতার তরুণ দম্পতিরা তাদের সম্পর্কে উন্মুক্ততা এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে।
রোমান্টিক স্থান: প্রেমের নতুন ক্যানভাস
কলকাতার দম্পতিরা তাদের সম্পর্ককে প্রাণবন্ত রাখতে শহরের রোমান্টিক স্থানগুলো বেছে নিচ্ছেন। প্রিন্সেপ ঘাট, ইকো পার্ক, রবীন্দ্র সরোবর, এবং মিলেনিয়াম পার্কের মতো জায়গাগুলো দম্পতিদের জন্য প্রিয় গন্তব্য। প্রিন্সেপ ঘাটে হুগলি নদীর তীরে নৌকা ভ্রমণ বা সূর্যাস্ত দেখা, ইকো পার্কে প্রকৃতির মাঝে হাঁটা, বা বোটানিক্যাল গার্ডেনে গাছের ছায়ায় শান্ত মুহূর্ত কাটানো—এই সবই দম্পতিদের মধ্যে রোমান্স জাগিয়ে তুলছে। এছাড়া, গঙ্গার উপর হেরিটেজ ক্রুজ বা গাব্বার্স বার অ্যান্ড কিচেনের মতো রেস্তোরাঁয় বলিউডের ছোঁয়ায় রোমান্টিক ডিনার দম্পতিদের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা।
সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি এবং চ্যালেঞ্জ
যদিও কলকাতার তরুণ দম্পতিরা সম্পর্কের নতুন ধারণা গ্রহণ করছে, সমাজের রক্ষণশীল অংশ এখনও এই পরিবর্তন মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। ২০২৫ সালে ওয়াইও হোটেলগুলো অবিবাহিত দম্পতিদের জন্য নতুন নীতি প্রবর্তন করেছে, যেখানে সম্পর্কের বৈধ প্রমাণ দেখাতে হবে। তবে, তরুণরা এই বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে এবং তাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে।
কলকাতার দম্পতিরা ২০২৫ সালে শহুরে সম্পর্ককে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছে। প্রযুক্তির ব্যবহার, লিভ-ইন সম্পর্ক, এবং পলিঅ্যামরির মতো নতুন ধারণার মাধ্যমে তারা সমাজের প্রচলিত সীমানা ভাঙছে। শহরের রোমান্টিক স্থানগুলো তাদের প্রেমকে আরও রঙিন করছে। যদিও সমাজের কিছু অংশ এখনও এই পরিবর্তন মেনে নিতে দ্বিধাগ্রস্ত, কলকাতার তরুণ প্রজন্ম তাদের স্বাধীনতা এবং প্রেমের অধিকারের জন্য অটল। এই শহরে প্রেম এখন শুধু হৃদয়ের ব্যাপার নয়, এটি স্বাধীনতা, স্বচ্ছতা এবং আধুনিকতার প্রতীক।