উত্তর কলকাতার শিল্প ও দৈনন্দিন জীবন মিলেমিশে একাকার কুমোরটুলিতে!

উত্তর কলকাতার কুমোরটুলি (Kumartuli) শুধু একটি স্থান নয়, এটি একটি জীবন্ত ঐতিহ্য, যেখানে শিল্প ও দৈনন্দিন জীবন অপূর্বভাবে মিশে গেছে। গঙ্গার তীরে অবস্থিত এই ছোট্ট…

Inside Kumartuli Discover Kolkata’s Iconic Idol-Making Heritage Hub

উত্তর কলকাতার কুমোরটুলি (Kumartuli) শুধু একটি স্থান নয়, এটি একটি জীবন্ত ঐতিহ্য, যেখানে শিল্প ও দৈনন্দিন জীবন অপূর্বভাবে মিশে গেছে। গঙ্গার তীরে অবস্থিত এই ছোট্ট পাড়া পৃথিবীবিখ্যাত মৃৎশিল্পের কেন্দ্র, যেখানে প্রতিমা তৈরির কারিগররা তাদের হাতের জাদুতে দেব-দেবীর মূর্তি ফুটিয়ে তুলে বাংলার সংস্কৃতিকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছেন। কুমোরটুলির গলি-গলি, কর্মশালা আর শিল্পীদের জীবনযাত্রা এক অনন্য গল্প বলে, যেখানে শিল্প, পরিশ্রম এবং ঐতিহ্য একসঙ্গে মিলিত হয়।

কুমোরটুলির শিল্পের উৎস
কুমোরটুলির ইতিহাস প্রায় তিনশো বছরের পুরোনো। ১৮ শতকে এই এলাকায় মাটির প্রতিমা তৈরির কারিগররা বসতি স্থাপন করেন। নামের উৎপত্তি ‘কুমোর’ শব্দ থেকে, যার অর্থ মাটির কারিগর। এখানকার শিল্পীরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে দুর্গা, কালী, সরস্বতী, গণেশ, কার্তিকের মতো দেব-দেবীর প্রতিমা তৈরি করে আসছেন। দুর্গাপুজোর সময় কুমোরটুলি তার পূর্ণ জৌলুসে ফুটে ওঠে, যখন হাজার হাজার প্রতিমা তৈরির কাজে এই পাড়া ব্যস্ত হয়ে ওঠে। তবে, শুধু পুজোর সময় নয়, বছরভর এখানকার কর্মশালাগুলোতে শিল্পের সৃষ্টি চলতে থাকে।

   

শিল্প ও দৈনন্দিন জীবনের মেলবন্ধন
কুমোরটুলির গলিতে ঢুকলেই চোখে পড়ে মাটির গন্ধ, খড়ের স্তূপ, আর রঙের পাত্রে ভরা কর্মশালা। এখানকার শিল্পীরা কেবল প্রতিমা তৈরি করেন না, তারা তাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত শিল্পের সঙ্গে মিশিয়ে দেন। সকাল থেকে রাত অবধি এই কর্মশালাগুলোতে কাজ চলে। শিল্পী রমেন পাল, যিনি তিন প্রজন্ম ধরে প্রতিমা তৈরি করছেন, বলেন, “আমাদের জন্য প্রতিমা তৈরি শুধু পেশা নয়, এটি আমাদের ধর্ম, আমাদের জীবন। প্রতিটি মূর্তিতে আমরা আমাদের ভালোবাসা আর ভক্তি ঢেলে দিই।”

কুমোরটুলির শিল্পীদের জীবন সহজ নয়। তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা পরিশ্রম, সংগ্রাম আর শিল্পের এক অপূর্ব মিশ্রণ। বর্ষায় কর্মশালায় জল ঢুকে যায়, গ্রীষ্মে তীব্র গরমে মাটি শুকিয়ে ফাটে, তবু তারা তাদের কাজ থামান না। স্থানীয় শিল্পী মিনতি পাল বলেন, “আমরা সারা বছর কাজ করি, কিন্তু দুর্গাপুজোর সময় আমাদের রাত-দিন এক হয়ে যায়। তবু, যখন আমাদের তৈরি মূর্তি পুজোর মণ্ডপে দেখি, তখন সব কষ্ট ভুলে যাই।”

শিল্পের বিবর্তন
কুমোরটুলির শিল্প সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিবর্তিত হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী প্রতিমার পাশাপাশি আধুনিক শিল্পের ছোঁয়াও এখানে দেখা যায়। পরিবেশবান্ধব প্রতিমা তৈরির প্রতি জোর দেওয়া হচ্ছে, যেখানে প্রাকৃতিক রং এবং জৈব উপাদান ব্যবহার করা হয়। তরুণ শিল্পী প্রদীপ সাহা বলেন, “আমরা এখন পরিবেশের কথা ভেবে কাজ করি। কৃত্রিম রংয়ের বদলে প্রাকৃতিক রং ব্যবহার করছি, যাতে নদী দূষিত না হয়।” এছাড়া, বিদেশে প্রতিমা রপ্তানির চাহিদা বেড়েছে, যার ফলে কুমোরটুলির শিল্পীরা আন্তর্জাতিক বাজারেও স্থান করে নিচ্ছেন।

কিন্তু এই বিবর্তনের পথে চ্যালেঞ্জও কম নয়। আধুনিক যুগে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে প্রতিমা তৈরির প্রতি আগ্রহ কমছে। অনেকে অন্য পেশার দিকে ঝুঁকছেন। শিল্পী গোপাল পাল বলেন, “আমার ছেলে এই পেশায় আসতে চায় না। সে বলে, এই কাজে পরিশ্রম বেশি, আয় কম। তবু আমি আশা করি, আমাদের ঐতিহ্য টিকে থাকবে।”

Advertisements

দৈনন্দিন জীবনের ছবি
কুমোরটুলির দৈনন্দিন জীবন শিল্পের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সকালে গঙ্গার তীরে শিল্পীরা মাটি সংগ্রহ করেন, দুপুরে খড় আর মাটি দিয়ে মূর্তির কাঠামো তৈরি হয়, আর সন্ধ্যায় রঙের আঁচড়ে মূর্তি জীবন্ত হয়ে ওঠে। এই কর্মশালাগুলোর পাশেই রয়েছে শিল্পীদের ছোট ছোট বাড়ি, যেখানে তাদের পরিবারের সদস্যরাও প্রায়ই কাজে হাত লাগান। বাচ্চারা খেলার ফাঁকে মাটির গোলা তৈরি করে, আর মায়েরা মাঝেমধ্যে রঙের পাত্র সাজিয়ে দেন। এই পাড়ায় শিল্প আর জীবন এমনভাবে মিশে গেছে যে একটিকে আরেকটি থেকে আলাদা করা কঠিন।

কুমোরটুলির বাজারও একটি জীবন্ত ছবি। এখানে মাটির প্রতিমার পাশাপাশি চায়ের দোকান, মুদির দোকান আর ছোট ছোট খাবারের ঠেলাগাড়ি জীবনের ছন্দ বজায় রাখে। পুজোর সময় এই বাজারে ভিড় বাড়ে, যখন দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ প্রতিমা দেখতে আসেন। এক্স-এ একটি পোস্টে বলা হয়েছে, “কুমোরটুলি বাংলার শিল্পের হৃৎপিণ্ড। এখানকার প্রতিটি মূর্তি একটি গল্প বলে।” এই পোস্টটি কুমোরটুলির সাংস্কৃতিক গুরুত্বকে তুলে ধরে।

সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতিফলন
কুমোরটুলি শুধু প্রতিমা তৈরির কেন্দ্র নয়, এটি বাংলার সংস্কৃতির একটি জীবন্ত প্রতিফলন। এখানকার শিল্পীরা তাদের প্রতিমার মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন। যেমন, গত বছর একটি দুর্গা প্রতিমায় মহিলা শক্তির প্রতীক হিসেবে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে বার্তা দেওয়া হয়েছিল। এই ধরনের প্রতিমা সমাজের প্রতি শিল্পীদের দায়বদ্ধতা দেখায়।

কুমোরটুলির শিল্পীরা তাদের কাজের মাধ্যমে বাংলার সংস্কৃতিকে বিশ্বের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, দুবাইয়ের মতো শহরে কুমোরটুলির প্রতিমা পুজোর মণ্ডপে শোভা পায়। এটি শুধু শিল্পীদের গর্ব নয়, বাংলার গর্বও বটে। তবে, শিল্পীদের জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং আর্থিক সহায়তার প্রয়োজন রয়েছে, যাতে এই ঐতিহ্য টিকে থাকে।

কুমোরটুলি বাংলার শিল্প ও সংস্কৃতির এক অমূল্য সম্পদ। এখানকার শিল্পীরা তাদের হাতের জাদুতে দেব-দেবীর মূর্তি তৈরি করেন, আর তাদের জীবনযাত্রায় মিশে থাকে সংগ্রাম, ভক্তি আর ঐতিহ্য। কুমোরটুলির গল্প শুধু মাটির মূর্তির নয়, এটি শিল্পীদের স্বপ্ন, পরিশ্রম আর বাংলার গর্বের গল্প। এই পাড়া বাংলার সাংস্কৃতিক হৃৎপিণ্ড হিসেবে চিরকাল টিকে থাকবে, যতদিন শিল্প আর জীবন এখানে একসঙ্গে প্রবাহিত হবে।