শিক্ষক নিয়োগ কেলেঙ্কারিতে তৃণমূলের দুর্নীতি নিয়ে ‘বিস্ফোরক’ দিলীপ ঘোষ

শান্তনু পান, পশ্চিম মেদিনীপুর: পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তৃণমূল কংগ্রেস (TMC) বর্তমানে একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগের মুখোমুখি। খড়গপুরে বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষের (Dilip Ghosh) অভিযোগ, রাজ্যের…

Dilip Ghosh Asked to Remain Active, Says BJP Top Brass

শান্তনু পান, পশ্চিম মেদিনীপুর: পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তৃণমূল কংগ্রেস (TMC) বর্তমানে একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগের মুখোমুখি। খড়গপুরে বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষের (Dilip Ghosh) অভিযোগ, রাজ্যের শিক্ষক নিয়োগ কেলেঙ্কারির কারণে প্রায় ২৬,০০০ শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী তাদের চাকরি হারিয়েছেন, এবং এর পেছনে তৃণমূল নেতাদের দুর্নীতির বড় হাত রয়েছে। এই ঘটনা তৃণমূলের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামোর গভীরে থাকা সমস্যাগুলোকে প্রকাশ্যে এনেছে। এই কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন দলের শীর্ষ নেতারা, যার মধ্যে মদন মিত্র ও অনুব্রত মণ্ডলের মতো প্রভাবশালী নেতাদের নামও উঠে এসেছে। এই ঘটনা তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ কালচার এবং প্রশাসনের উপর গভীর প্রশ্ন তুলেছে।

শিক্ষক নিয়োগ কেলেঙ্কারি: ২৬,০০০ চাকরি বাতিল
পশ্চিমবঙ্গের স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি) নিয়োগ কেলেঙ্কারি রাজ্যের রাজনীতিতে একটি বড় ধাক্কা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে সিবিআই তদন্তে প্রকাশ পেয়েছে, অযোগ্য প্রার্থীদের ঘুষের বিনিময়ে চাকরি দেওয়া হয়েছে। এই কেলেঙ্কারির ফলে প্রায় ২৬,০০০ শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী তাদের চাকরি হারিয়েছেন। বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষ দাবি করেছেন, এই দুর্নীতির পেছনে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে। তিনি অভিযোগ করেছেন, “তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরা এই দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত। এই কেলেঙ্কারি এত বড় যে, তদন্ত যদি পুরোপুরি এগোয়, তাহলে দলের সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত এর প্রভাব পৌঁছবে।”

   

এক্স-এ পোস্টে দেখা গেছে, সাধারণ মানুষ ও বিরোধী দলের নেতারা এই ঘটনাকে তৃণমূলের দুর্নীতির একটি কলঙ্কিত অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। একটি পোস্টে বলা হয়েছে, “তৃণমূল নেতাদের ঘুষ নিয়ে চাকরি দেওয়ার কারণে ২৬,০০০ শিক্ষক তাদের জীবিকা হারিয়েছেন। এটা তৃণমূলের লজ্জার বিষয়।” এই ঘটনা শুধু শিক্ষকদের জীবনেই প্রভাব ফেলেনি, বরং রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থার উপরও গভীর প্রশ্ন তুলেছে।

মদন মিত্রের স্বীকারোক্তি: দুর্নীতির স্বীকৃতি?
তৃণমূলের প্রভাবশালী নেতা মদন মিত্র প্রকাশ্যে এই দুর্নীতির বিষয়ে কথা বলেছেন, যা অনেকের কাছে আত্মগ্লানির প্রকাশ বলে মনে হচ্ছে। মদন মিত্র, যিনি নারদা কেলেঙ্কারিতে ২০২১ সালে সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন, সম্প্রতি স্বীকার করেছেন যে দলের মধ্যে দুর্নীতি রয়েছে। তিনি বলেছেন, “অনেক সময় সত্য বলে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।” তাঁর এই মন্তব্য দলের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। তবে, তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব এই বিষয়ে চুপ থাকার চেষ্টা করছে, যাতে দলের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

অনুব্রত মণ্ডল: তৃণমূলের ‘বাহুবলী’ এবং বিতর্ক
তৃণমূলের আরেক প্রভাবশালী নেতা অনুব্রত মণ্ডল, যিনি বীরভূম জেলার দলীয় সভাপতি ছিলেন, তাঁর নামও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। ২০২২ সালে সিবিআই তাঁকে গরু পাচার কেলেঙ্কারির অভিযোগে গ্রেফতার করে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি এই পাচার থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করেছেন, যার মূল্য প্রায় ৫৫০ কোটি টাকা। এছাড়া, সম্প্রতি তিনি একজন পুলিশ অফিসারকে ফোনে হুমকি দেওয়ার অভিযোগে আবারও বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়েছেন। একটি ভাইরাল অডিও ক্লিপে তাঁকে অশ্লীল ভাষায় পুলিশ অফিসারকে গালাগাল করতে শোনা গেছে। এই ঘটনার পর তৃণমূল তাঁকে শোকজ করলেও, দলের শীর্ষ নেতৃত্ব তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছে।

Advertisements

দিলীপ ঘোষ অভিযোগ করেছেন, “অনুব্রত মণ্ডলের মতো নেতারা তৃণমূলের মেরুদণ্ড। তারা দলের জন্য হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করেছেন। তাই তৃণমূল কখনোই তাঁদের ছাড়তে পারবে না।” তিনি আরও বলেন, “অনুব্রত পুলিশকে নিয়ন্ত্রণ করতেন, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ সুপার নিয়োগে তাঁর হাত ছিল। তিনি বিরোধীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদের হয়রানি করতেন।” এই অভিযোগগুলো তৃণমূলের প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহারের একটি চিত্র তুলে ধরে।

পুলিশ ও সিবিআইয়ের ভূমিকা
দিলীপ ঘোষ আরও অভিযোগ করেছেন, রাজ্য পুলিশ এবং কিছু সিবিআই অফিসার তৃণমূলের সঙ্গে ‘সেটিং’ করে কাজ করেছেন, যার ফলে দুর্নীতির তদন্তে অগ্রগতি হয়নি। তবে, সিবিআই এবং ইডি-র তদন্তে এখন অনেক তৃণমূল নেতার নাম উঠে আসছে। অনুব্রত মণ্ডলের গ্রেফতারির পর তাঁর সম্পত্তি এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের সম্পত্তির তদন্ত চলছে। তবে, তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব এই তদন্তকে ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসা’ বলে অভিহিত করেছে।

তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ কালচার
অনুব্রত মণ্ডলের মতো নেতাদের উপর তৃণমূলের নির্ভরতা দলের অভ্যন্তরীণ কাঠামোর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। বিশেষজ্ঞ বিশ্বনাথ চক্রবর্তী বলেন, “অনুব্রত তৃণমূলের রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতীক। তাঁর গ্রেফতারি দলের গোষ্ঠীকেন্দ্রিক কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করছে।” তৃণমূলের কিছু নেতা, যেমন মদন মিত্র, দলের দুর্নীতির বিষয়ে প্রকাশ্যে কথা বললেও, দলের শীর্ষ নেতৃত্ব এই বিষয়ে নীরবতা পালন করছে। এই ঘটনাগুলো তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ কালচার এবং প্রশাসনের উপর নেতাদের প্রভাবের একটি চিত্র তুলে ধরে।

শিক্ষক নিয়োগ কেলেঙ্কারি থেকে গরু পাচার, তৃণমূল কংগ্রেস বর্তমানে দুর্নীতির অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে। মদন মিত্র ও অনুব্রত মণ্ডলের মতো নেতাদের বিতর্কিত মন্তব্য ও কর্মকাণ্ড দলের ভাবমূর্তিকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। দিলীপ ঘোষের মতে, তৃণমূলের এই দুর্নীতি এত গভীরে প্রোথিত যে, তদন্ত পুরোপুরি এগোলে দলের অস্তিত্বই বিপন্ন হতে পারে। তবে, তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব এই অভিযোগগুলোকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বলে উড়িয়ে দিচ্ছে। ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে এই ঘটনাগুলো রাজ্যের রাজনীতিতে কী প্রভাব ফেলবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে, এই কেলেঙ্কারি রাজ্যের জনগণের মধ্যে তৃণমূলের প্রতি অসন্তোষ বাড়িয়ে তুলছে, এবং এর প্রভাব ভবিষ্যৎ নির্বাচনে দেখা যেতে পারে।