নিউ জলপাইগুড়িতে বার্মা টিক কাঠ পাচারের ছক বানচাল, রেলের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন

সৌরভ রায়, শিলিগুড়ি: বেআইনি কারবারের জাল যেন ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে। দিন দিন বাড়ছে নানা ধরনের চোরাচালান, এবং এবার ভারতীয় রেলকে ব্যবহার করে বার্মা (মায়ানমার) থেকে…

Burma Teak Smuggling Busted at New Jalpaiguri Station, Raises Rail Security Concerns

সৌরভ রায়, শিলিগুড়ি: বেআইনি কারবারের জাল যেন ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে। দিন দিন বাড়ছে নানা ধরনের চোরাচালান, এবং এবার ভারতীয় রেলকে ব্যবহার করে বার্মা (মায়ানমার) থেকে আনা টিক কাঠের পাচারের (Burma Teak Smuggling) একটি বড় চক্রের পর্দাফাঁস হয়েছে। শিলিগুড়ির কাছে নিউ জলপাইগুড়ি রেলওয়ে স্টেশনের ২ নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মালবাহী ট্রেন থেকে প্রচুর পরিমাণে বার্মা টিক কাঠের লগ উদ্ধার করেছে গভর্নমেন্ট রেলওয়ে পুলিশ (জিআরপি) এবং রেলওয়ে প্রোটেকশন ফোর্স (আরপিএফ)। এই ঘটনা কেবল চোরাচালানের বিশালতা প্রকাশ করেনি, বরং ভারতীয় রেলের নিরাপত্তা ব্যবস্থার উপরও গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে।

বৃহস্পতিবার, গোপন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জিআরপি এবং আরপিএফ-এর যৌথ অভিযানে এই বিপুল পরিমাণ কাঠ উদ্ধার হয়। জানা গেছে, অসম থেকে হাওড়ার উদ্দেশে যাওয়া এই মালবাহী ট্রেনটি নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে থামার পর তল্লাশি শুরু হয়। একের পর এক ওয়াগন খুলে তল্লাশি চালাতে গিয়ে রেল পুলিশ কর্মকর্তারা চমকে ওঠেন। প্রায় প্রতিটি কোচই বার্মা টিক কাঠে ভর্তি ছিল। এই কাঠের বাজার মূল্য কোটি টাকারও বেশি বলে প্রাথমিকভাবে অনুমান করা হচ্ছে।

   

বার্মা টিক কাঠের উচ্চ চাহিদা এবং আন্তর্জাতিক বাজারে এর দামের কারণে এটি চোরাচালানের একটি লোভনীয় পণ্য। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মায়ানমারের টিম্বার এন্টারপ্রাইজের উপর নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও, ভারতের মাধ্যমে এই কাঠ পাচারের ঘটনা বেড়েছে। এই ঘটনা শুধুমাত্র অবৈধ কাঠ ব্যবসার বিস্তৃত নেটওয়ার্কের ইঙ্গিত দেয় না, বরং ভারত-মায়ানমার সীমান্তে নিরাপত্তার দুর্বলতার দিকেও ইঙ্গিত করে।

এই ঘটনার পর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন উঠেছে, কীভাবে এত কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং তল্লাশির মধ্যেও এত বিপুল পরিমাণ কাঠ মালবাহী ট্রেনে লোড করা হল? রেলওয়ের মতো একটি সংবেদনশীল পরিবহণ ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে এই ধরনের চোরাচালান কীভাবে সম্ভব হল, তা নিয়ে স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেকে মনে করছেন, এর পেছনে একটি বড় চক্র কাজ করছে, যার সঙ্গে হয়তো কিছু অসাধু কর্মকর্তা বা স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের যোগসাজশও থাকতে পারে।

জিআরপি এবং আরপিএফ এই ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে। তবে, এখনও পর্যন্ত কোনও গ্রেফতার বা অফিশিয়াল বিবৃতি প্রকাশ করা হয়নি। সূত্রের খবর, এই কাঠ গুয়াহাটি থেকে মহারাষ্ট্রের দিকে পাচার করা হচ্ছিল। এর আগেও, ২০২২ সালের নভেম্বরে জলপাইগুড়ি জেলার পানিকৌড়িতে এবং ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে নক্সালবাড়িতে বার্মা টিক কাঠের বড় চালান উদ্ধার হয়েছিল। এই ঘটনাগুলো ইঙ্গিত দেয় যে উত্তর-পূর্ব ভারত, বিশেষ করে মায়ানমার সীমান্তবর্তী অঞ্চল, অবৈধ কাঠ পাচারের একটি বড় কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।

Advertisements

এই ঘটনা শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতির বিষয় নয়, বরং পরিবেশের উপরও এর গভীর প্রভাব রয়েছে। বার্মা টিক কাঠ অত্যন্ত মূল্যবান এবং এর অবৈধ কাটা মায়ানমারের বনাঞ্চল ধ্বংস করছে। এছাড়া, এই চোরাচালানের সঙ্গে সংঘবদ্ধ অপরাধ এবং দুর্নীতির যোগসূত্রও উঠে আসছে, যা ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি।

স্থানীয় বাসিন্দা এবং বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই ধরনের ঘটনা রোধ করতে আরও কঠোর নজরদারি এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রয়োজন। ভারত-মায়ানমার সীমান্তে বেশি নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন, রেলওয়ের মালবাহী ট্রেনে নিয়মিত তল্লাশি, এবং স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে আরও সমন্বয় জরুরি। এছাড়া, চোরাচালানের পেছনে যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

এই ঘটনার পর রেল কর্তৃপক্ষ কী পদক্ষেপ নেয়, এবং তদন্তে কী কী তথ্য সামনে আসে, তা নিয়ে সবার নজর রয়েছে। নিউ জলপাইগুড়ির এই ঘটনা কেবল একটি চোরাচালানের ঘটনা নয়, বরং ভারতের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং অবৈধ বাণিজ্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সামনের দিনগুলোতে এই তদন্ত কোন দিকে মোড় নেয়, তা এখন দেখার বিষয়।