Lionel Messi : বিশ্বরেকর্ডের সামনে আর্জেন্টিনা, বিশ্বকাপের সামনে মেসি!

এ এক অদ্ভুত জ্বালা! তর্কটা কিছুতেই থামতে চায় না। সে শচীন-লারা হোন বা পেলে-মারাদোনা, মেসি (Lionel Messi)-রোনাল্ডো হোন বা শাহরুখ-আমির। বলিউড থেকে বাইশগজ, ক্রিকেট থেকে…

এ এক অদ্ভুত জ্বালা! তর্কটা কিছুতেই থামতে চায় না। সে শচীন-লারা হোন বা পেলে-মারাদোনা, মেসি (Lionel Messi)-রোনাল্ডো হোন বা শাহরুখ-আমির। বলিউড থেকে বাইশগজ, ক্রিকেট থেকে ফুটবল, ‍‘কে সেরা’ এই প্রশ্নে যুগ যুগ ধরে উথাল-পাতাল বিশ্বব্রহ্মান্ড। আট থেকে আশি- নির্দ্বিধায় তর্কে সামিল হয়ে যান সকলেই। কিন্তু উত্তর মেলা ভার!

আসলে একটা সময়ের পর যেমন প্রতিভা মলিন হয়ে যায়, ঠিক তেমনই পরবর্তী পরম্পরা সেই প্রতিভার উত্তাপ টেরও পায় না। চাক্ষুস না করা অতীতের থেকে সকলের কাছে বেশি প্রিয় এবং বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে বর্তমানটা। তাই তো পেলের থেকে এ যুগের তরুণ ফুটবলপ্রেমীদের কাছে মেসি বেশি প্রিয়। তবুও সময় বিশেষে তরজাটা চলতে থাকবে চিরকালই। আর ‍‘গুগল’ বাবাজীবনের সৌজন্যে অমর হয়ে থাকবে পরিসংখ্যান।

   

কেউ কেই আবার এইসব ঠুনকো পরিসংখ্যানের তোয়াক্কা করেন না। ‍‘লিওনেল মেসির হাতে বিশ্বকাপ নেই বলে দিয়াগো মারাদোনাই সেরা’ এই গোছের মন্তব্যকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন তারা। ‍‘হনুমান’ রূপী এই সব মানুষের কাছে মেসি যে তাদের ‍‘রাম’। হবেন নাই বা কেন? কী নেই এই ভদ্রলোকের ঝুলিতে? ব্যালন ডি অর, ফিফা দি বেস্ট, লা লিগা, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি, বিশ্বকাপের সেরা ফুটবলারের পুরস্কার, একটি কোপা আমেরিকা ট্রফি, কোপার সেরা ফুটবলার, সদ্য যোগ হল ফাইনালিসিমা… প্রাপ্তির ভাণ্ডারে নেই বলতে শুধুই বিশ্বকাপ। এছাড়া ফুটবল থেকে আর্জেন্টাইন যুবরাজের নতুন করে আর কিছু পাওয়ার আছে বলে তো মনে হয় না। তাই কেরিয়ারের সায়াহ্নে এসে নিজেকে নতুন করে প্রমাণ করার তাগিদটাও হয়তো নেই।

ফুটবলটাকে যেন একেবারে জল-ভাত করে ফেলেছেন তিনি। এবার তাই পাখির চোখ সেই অধরা বস্তুটি। বিশ্বকাপের ট্রফি। কাতারে এই ট্রফি উঁচিয়ে ধরলেই তো সমস্ত বাক-বিতণ্ডায় ফুলস্টপ ফেলে দেবেন তিনি। চরম নিন্দুকরাও বাধ্য হবেন তাঁর প্রেমে পড়তে। কারণ তখন তো প্রাপ্তি ভাঁড়ারটাও একেবারে পূর্ণ হয়ে যাবে যুবরাজের। আর সেই চেষ্টা কি মেসি করবেন না কাতারে? ফুটবল জগতে একচ্ছত্রাধিপতি হিসাবে নিজেকে তুলে ধরতে কোনও খামতি কিন্তু তিনি রাখবেন না। ৩২ ম্যাচ আগে যে যাত্রা শুরু হয়েছে মেসিকে সামনে রেখে, তা কোথায় থামবে কেউ জানে না। তবে তাঁর প্রাক্তন কিছু গুরু যেমন জর্জ সাম্পাওলি, পেপ গুয়ার্দিলারা মনে করছেন, মেসির ‍‘আর্জেন্টিনা’ নামক ট্রেনের শেষ স্টেশন হতে চলেছে কাতার।

বিশ্বজয় করে যুবরাজ থেকে রাজাধিরাজে পরিণত হবেন মেসি। তখন উপর থেকে স্বয়ং মারাদোনাও হয়তো তাঁর উত্তরসূরিকে স্যালুট জানাবেন। নিন্দুকরা তো কোন ছাড়! সাম্প্রতিককালে মেসি তাঁর দলবলকে সঙ্গে নিয়ে যেরকম অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছেন, তাতে মনে হচ্ছে কাতার জয় স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। ২০১৯ সালের কোপা আমেরিকা সেমিফাইনাল থেকে বিদায়। ব্যাস, সেই শেষ। তারপর থেকেই পরিণত মেসির জাদুকরী পায়ের মন্ত্রবলে প্রায় তিন বছর এক নাগারে ছুটে চলেছে আর্জেন্টিনা। ওই টুর্নামেন্টের পর থেকে ৩২টি ম্যাচ খেলেছে দু’বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা। ধরে রেখেছে অপরাজিত তকমা। শিরোপা জিতেছে ২টি।

ইটালিতে হারিয়ে ফাইনালিসিমা জয়ের পর তো বিশ্বরেকর্ডের একেবারে দোরগোড়ায় চলে এসেছে আর্জেন্টিনা। কাকতালীয়ভাবে যাদের হারিয়ে ফাইনালিসিমা জিতেছেন মেসিরা, সেই ইটালির দখলেই রয়েছে অপরাজিত থাকার বিশ্বরেকর্ড। ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত টানা ৩৭ ম্যাচ অপরাজিত ছিল রবার্তো মানচিনির দল। এই সময়ের মধ্যে তারা জিতেছে ইউরো কাপ। তবে দুঃখজনকভাবে বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করতে পারেনি আজুরি বাহিনী।

ইটালির পর তালিকায় আছে ব্রাজিল। ১৯৯৩ সাল থেকে টানা ৩৫ ম্যাচ অপরাজিত ছিল রোমারিও-দুঙ্গাদের দল। ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপ ট্রফিও ঘরে তুলেছিল তারা। ব্রাজিলের সমান ৩৫ ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ড স্পেনের রয়েছে। ফুরিয়া রোহাদের স্বর্ণালি প্রজন্ম ২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত হারেনি। এর মধ্যে ২০০৮ সালের ইউরো জয় করে জাভি-ইনিয়েস্তারা। ২০১০ সালে জেতে বিশ্বকাপও।

এরপরই লিওনেল স্কালোনির বর্তমান আর্জেন্টিনা দল। টানা ৩২ ম্যাচ হারের মুখ দেখেনি। ফাইনালিসিমা জিতে মেসির আর্জেন্টিনা ছাপিয়ে গিয়েছে মারাদোনার আর্জেন্টিনাকেও। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত ৩১ ম্যাচ অপরাজিত ছিলেন হ্যান্ড অফ গডের দেশ। বিশ্বকাপের আগে অন্তত তিনটি প্রস্তুতি ম্যাচ খেলবে তারা। আর বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে আর্জেন্টাইনদের প্রতিপক্ষ সৌদি আরব, মেক্সিকো ও পোল্যান্ড। তাই আশা করা যাচ্ছে অপরাজিত থাকার বিশ্বরেকর্ড গড়ে তবেই বিশ্বকাপের নকআউটে যাবে মেসি বাহিনী। আর কাতারের বাকি পর্যায়কে মেসিময় করতে হয়তো কোনও সুযোগই হাতছাড়া করবেন না ডি মারিয়া-দিবালারা।

আর মেসি! আর্জেন্টাইন সমর্থকদের যাবতীয় সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আশা-প্রত্যাশা সবটুকু তো এই লোকটিকে ঘিরেই। আর্জেন্টিনার নামক রথের সারথি যে তিনিই। আর্জেন্টিনার তামাম ফুটবলপ্রেমীদের কাছে মেসিই যেন হ্যামিলটনের বাঁশিওয়ালা। এবার হয়তো কল্পনার ফুটবল দেবতাও মুখ ফিরিয়ে নেবেন না বাস্তবের ফুটবল দেবতার থেকে। কোপা, ফাইনালিসিমার পর মেসির তৃপ্ত অথচ দৃপ্ত মুখ যেন বলে দিয়ে গেল, ‍‘কাতার, তৈরি থাকো। আমি আসছি।’