Lata Mangeshkar: শুধু সুর নয়, মানবিকতারও সম্রাজ্ঞী লতাকে চিরকাল মনে রাখবে ভারতীয় ক্রিকেট

সালটা ১৯৮৩। প্রথমবার বিশ্বজয় করে ফিরল ভারত। কপিল দেবের নেতৃত্বে ভারতের বিশ্বকাপ জয়ে তখন সারা দেশ আনন্দে আত্মহারা। এদিকে বিসিসিআইয়ের পকেট তো ঠনঠন করছে! বিশ্বজয়…

সালটা ১৯৮৩। প্রথমবার বিশ্বজয় করে ফিরল ভারত। কপিল দেবের নেতৃত্বে ভারতের বিশ্বকাপ জয়ে তখন সারা দেশ আনন্দে আত্মহারা। এদিকে বিসিসিআইয়ের পকেট তো ঠনঠন করছে! বিশ্বজয় করে আসা ক্রিকেটারদের কীভাবে পুরস্কৃত করবে বোর্ড, সেই নিয়ে তখন তোধামোধা অবস্থা।

এমন সময় এগিয়ে এসেছিলেন বোর্ডের ‍‘পরম বন্ধু’ লতা মঙ্গেশকর (Lata Mangeshkar)। বিশ্বকাপের মতো টুর্নামেন্ট জয় করা ভারতীয় দলকে পুরস্কৃত করা দূরের কথা, আর্থিক দিক থেকে তখন বোর্ড এতটাই ধুঁকছিল যে ক্রিকেটারদের দৈনিক ভাতার ২০ পাউন্ড করে দিতেও গলদঘর্ম অবস্থা হত বিসিসিআইয়ের। সেই বোর্ডের পক্ষে বড়সড় উৎসব করে ক্রিকেটারদের অভ্যর্থনা জানানো বা বড় অঙ্কের পুরস্কার দেওয়ার কথা ভাবাই ছিল দুঃসাহসিকতার শামিল। তখনই এগিয়ে আসেন সুর সম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর। একটি কনসার্টে গান গাওয়ার মাধ্যমে ভারতীয় বোর্ডকে বিপুল অর্থ সংগ্রহ করে দেন তিনি।

আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগেই ঘটনা। প্রবল পরাক্রমশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজকে গুঁড়িয়ে লর্ডসের ব্যালকনিতে ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপ খেতাব উঁচিয়ে ধরেছিলেন ভারতের অধিনায়ক কপিল দেব। ভারতে তখন উৎসবের জোয়ার। কিন্তু ক্রিকেট বোর্ডের তৎকালীন সভাপতি, ইন্দিরা গান্ধীর ক্যাবিনেটের অন্যতম ক্ষমতা সম্পন্ন মন্ত্রী প্রয়াত এনকেপি সালভের মাথায় ছিল এক দুশ্চিন্তা। আর্থিক সংকট থেকে বের হওয়ার উপায় খুঁজতে ভারতীয় ক্রিকেটের এনসাইক্লোপিডিয়া হিসাবে খ্যাত রাজ সিং দুঙ্গারপুরের শরণাপন্ন হন সালভে। তখন আর কোনও পথ খোলা না দেখে বাধ্য হয়ে নিজের কাছের বন্ধু তথা ভারতীয় ক্রিকেটের পরম ভক্ত লতা মঙ্গেশকরকে দিল্লির জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে একটি কনসার্টে গান গাওয়ার অনুরোধ করেন দুঙ্গারপুর।

সেই অনুরোধ ফেলতে পারেননি লতা। তাঁর গান গাওয়ার খবরে ভরে যায় পুরো স্টেডিয়াম। মঞ্চে উঠে প্রায় দুই ঘণ্টা গান করেন লতা। আর এই অনুষ্ঠান থেকে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের এত বেশি আয় হয় যে, তারা বিশ্বকাপ জেতা দলের ১৪ সদস্যের প্রত্যেককে এক লক্ষ টাকা করে পুরস্কার দেয়। সেই সময় এক লক্ষ টাকা ছিল অনেক বেশি অর্থ। ঠিক কতটা বেশি তা বোঝাতে পিটিআই দলের সদস্য সুনিল ভালসন বলেন, ‘ওই সময় এই টাকা অনেক বড় অঙ্ক ছিল। আমরা সফরের অর্থ এবং মাসজুড়ে দৈনিক ভাতা জমিয়েও ৬০ হাজার টাকা একত্রিত করতে পারিনি।’ ভালসন আরও যোগ করেন, ‘আমার এখনও মনে আছে, কেউ কেউ বলছিল, আমরা তোমাদের ৫ হাজার টাকা দেব, কেউ বলছিল ১০ হাজার। এগুলো তখন খুবই অপমানজনক ছিল। এরপর লতাজি সেই কনসার্টে গান করলেন। সেই কনসার্টটি আমার অন্যতম স্মরণীয় একটি সন্ধ্যা ছিল। কারণ আমি তাঁকে চোখের সামনে গান করতে দেখেছি।’

একটি রেডিও ইন্টারভিউতে লতা স্বয়ং জানিয়েছিলেন, ‍‘প্রস্তাবটা আমি রাজি হয়ে যাই। ১৭ আগস্ট দিল্লিতে পৌঁছে যাই। আমি, সুরেশ ওয়াদেকর, নীতিন মুকেশ ওই অনুষ্ঠানে সাহায্য করেন। রাজীব গান্ধী উপস্থিত ছিলেন সেই অনুষ্ঠানে।’ লতা সেদিন গেয়েছিলেন ভাই হৃদয়নাথ মঙ্গেশকরের সুর করা ‍‘ভারত বিশ্ব বিজেতা’ বলে একটি গান। কপিল, গাভাসকররাও গলা মিলিয়েছিলেন সেই গানে। ক্রিকেট প্রেমী লতা বিনা পয়সায় গান গেয়ে যান। এটাই তাঁর মহানত্ম। তিনি সম্রাজ্ঞী শুধু সুরে নন, মানবিকতাতেও।

ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড এবং দুঙ্গারপুর কখনও ভোলেননি সেই বিশ্বকাপের পর কীভাবে বড় লজ্জার হাত থেকে তাদের বাঁচিয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর। তাই তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে ভারতের যে কোনও মাঠে, যে কোনও ম্যাচে লতার জন্য বরাদ্দ রাখা হত দু’টি করে ভিআইপি টিকিট। এই তথ্য অবশ্য আজ অনেকেরই অজানা। শুধু সেই কনসার্টে গান করাই নয়, ক্রিকেটের নিয়মিত অনুসারী ছিলেন লতা। মুম্বইয়ের ক্রিকেটের অন্যতম পরিসংখ্যানবিদ মাকারান্দ ওয়াইগাঙ্কারের স্মৃতিচারণে উঠে এসেছে কীভাবে সত্তর ও আশির দশকে নিয়মিত সিসিআই ও ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখতেন সুরের সরস্বতী। স্মৃতিচারণায় মাকারান্দ বলেন, ‘লতাজি এবং তাঁর ভাই তথা সুরকার হৃদিনাথ মঙ্গেশকর নিয়মিত ব্রাবোর্ন স্টেডিয়ামে টেস্ট ম্যাচ দেখতেন। এরপর সত্তরের দশকে নিজের ব্যস্ত সূচির মাঝেও খুব কম সময়ই কোনও ম্যাচ মিস করতেন লতা। মুম্বইয়ের কিংবদন্তি ওপেনার মাধব আপ্তে ও রাজ সিং দুঙ্গারপুরের সঙ্গে বসেও খেলা বহুবার দেখছেনে তিনি।’

মুম্বই থেকে উঠে আসা ক্রিকেটারদের মধ্যে সুনীল গাভাসকর, দিলীপ বেঙ্গসরকার এবং শচীন তেন্ডুলকরের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল লতার। শচীনের সঙ্গে তাঁর পারিবারিক সম্পর্কের কথা অনেকেই জানতেন। লতাকে অনেক সময় মা সরস্বতী বলেও ডাকতেন মাস্টার ব্লাস্টার। প্রায়ই ক্রিকেট ক্লাব অব ইন্ডিয়ায় বসে দুঙ্গারপুরের সঙ্গে নানান ক্রিকেটীয় আড্ডায় মশগুল হয়ে উঠতেন এই গানের পাখি। ক্রিকেট এবং লতার মধুচন্দ্রিমার বেশ কিছু গল্প আজ শুধুই ইতিহাস হয়ে গেল।

কিছু টুকরো ঘটনাই প্রমাণ, ক্রিকেটকে কতটা ভালবাসতেন লতা। সুরকার অজয় দাস এবং পরিচালক সুখেন দাসের উপস্থিতিতে ‘অনুরাগের ছোঁয়া’ সিনেমার গান রেকর্ড হচ্ছে মুম্বইয়ের স্টুডিওতে। তার কিছুক্ষণ পরেই ভারতীয় দলের লর্ডসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ফাইনাল খেলতে নামার কথা৷ ‘আমি যে কে তোমার, তুমি তা বুঝে নাও’ গানটির রেকর্ডিং শেষে সুরকার এবং পরিচালককে লতা বলেছিলেন, ‍‘ভারত বিশ্বকাপ জিতলে এই গানের সাম্মানিক তিনি নেবেন না।’ কথা রেখেছিলেন লতা মঙ্গেশকর। কপিলের হাতে বিশ্বকাপ ওঠায় প্রতিজ্ঞা মতো ওই গানের সম্মানিক নেননি তিনি। আরও একটি ঘটনা না বললেই নয়। ২০১১ বিশ্বকাপ ফাইনালে ধোনির ভারত মুখোমুখি শ্রীলঙ্কার। ভারতের বিশ্বকাপ জয়ের প্রার্থনায় উপোস করেছিলেন তিনি। শচীনের ব্যাটিংয়ের সময় ঠায় বসে থাকতেন টিভির সামনে। এই ধরনের ছোটখাটো ঘটনাই ক্রীড়া জগতের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে সুরসম্রাজ্ঞীর নাম৷

ডটার অফ দ্য নেশন আজ চলে গেলেন না ফেরার দেশে। একটা বিশাল শূন্যস্থান সৃষ্টি হল দেশের সংগীতাঙ্গনে। সেইসঙ্গে ভারতীয় ক্রিকেট হারাল তাদের প্রিয় বন্ধু, সবথেকে বড় ভক্তকেও। শুধু সংগীত কন্যা হিসাবেই নয়, চিরকাল ‍‘তুমি রবে নীরবে’ ভারতীয় ক্রিকেটেও।