Pele Dies At 82 : ফুটবলের কালোমানিক পেলে প্রয়াত

Pele Dies At 82 : আর নেই পেলে। ৮২ বছর বয়সে ফুটবল সম্রাট পেলে ইহলোক ত্যাগ করলেন, বিশ্ব ফুটবল ইতিহাসে একমাত্র ফুটবলার যে পর পর…

Pele Dies At 82

Pele Dies At 82 : আর নেই পেলে। ৮২ বছর বয়সে ফুটবল সম্রাট পেলে ইহলোক ত্যাগ করলেন, বিশ্ব ফুটবল ইতিহাসে একমাত্র ফুটবলার যে পর পর তিনটে বিশ্বকাপ জিতেছেন । অনেকদিন ধরেই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ভুগছিলেন, অবশেষে ফুটবল সম্রাট তার সাম্রাজ্য ত্যাগ করে চললেন তারাদের দেশে।

সর্বকালের সেরা ফুটবলার কে? পেলে না ম্যারাডোনা তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। তবে ফুটবলের সম্রাট কে তা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। কালো মানিক খ্যাত ব্রাজিলের পেলেকে বলা হয় ফুটবলের সম্রাট। অনেকে আবার ভাবতে পারেন পেলে যদি সম্রাট হন তাহলে ম্যারাডোনা কি? ম্যারাডোনাকে বলা হয় ফুটবলের রাজপুত্র।

জন্মটা সাধারণ এক বস্তিতে ১৯৪০ সালের ২৩ অক্টোবর ব্রাজিলের ত্রেস কোরাকোয়েস শহরের এক বস্তিতে জন্মেছিলেন পেলে। পেলে নাম কে রাখলো? আজ আমরা যাকে পেলে নামে চিনি জন্মের পর তার বাবা-মা তার নাম রাখেন বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসনের সঙ্গে মিল রেখে। পেলের পুরো নাম ‘এডসন অ্যারানটিস দো নাসিমেন্ট’। পর্তুগিজ উচ্চারণে এডিসনকে তাঁরা বলতেন এডসন। ‘এডসন অ্যারানটিস দো নাসিমেন্ট’ নামটা যে কী করে পেলে হয়ে গেল, পেলে নিজেও সেটা বলতে পারেন না। বস্তির বন্ধুরা পেলেকে চিনতো ‘ডিকো’ নামে।
ছোটবেলায় ছিলেন চায়ের দোকানের কর্মচারী দরিদ্র কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারের প্রথম সন্তান হিসেবে পরিবারের অভাব অনটন মেটানোর জন্য ছেলেবেলাতেই পেলেকে চায়ের দোকানে কাজ করতে হয়েছিল। এছাড়া রেলস্টেশন ঝাড়ু দেওয়ার পাশাপাশি কিছুদিন জুতা পরিষ্কারের কাজও করেছিলেন।

ছোটবেলা থেকেই ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন ছিল পেলের। একদিন সেই স্বপ্ন সত্যি হলো। ফুটবল খেলে বিশ্বজয় করল ছেলেটি। কিন্তু তার পেছনে রয়েছে আরও অনেক ইতিহাস। আসুন সে রকম কিছু তথ্য জেনে নিই।

সত্যিকারের ফুটবল কেনার টাকা ছিল না ফুটবলের দেশ ব্রাজিলের এক গরিব মা-বাবার পরিবারে জন্ম নেওয়া কালো ছেলেটির জীবনের গল্প অদ্ভুত রোমাঞ্চকর। ফুটবলে সহজাত প্রতিভা তো ছিলই, ব্রাজিলের আর দশটা সাধারণ ছেলের মতোই গলির ফুটবল ছিল তাঁরও অবসরের সঙ্গী। কিন্তু সত্যিকারের ফুটবল কেনার টাকা ছিল না বলে মোজার ভেতরে খবরের কাগজ ঠেসে বানানো ফুটবলে চলত তাঁর অনুশীলন।

গলির ফুটবলেই পেলের প্রতিভা ফুটে ওঠে। এই প্রতিভা একদিন চোখে পড়ে স্যান্টোসের গ্রেট ওয়ালডেমার ডি ব্রিটোর। জীবনের মোড় ঘোরা শুরু। সে সময় পেলের বয়স ছিল ১৫ বছর। ব্রিটো পেলেকে গলি থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেলেন স্যান্টোস ক্লাবে এবং অন্তর্ভুক্ত করেন স্যান্টোসের ‘বি’ টিমে। এখানেও সহজাত প্রতিভা দেখিয়ে এক বছরের মধ্যেই স্যান্টোসের মূল দলে নিজের জায়গা করে নেন পেলে।

প্রথম মৌসুমেই সর্বোচ্চ গোলদাতা:
পেলে যখন স্যান্টোসের মূল দলে যোগ দেন তখন তার বয়স ১৬ বছর। সেবার ব্রাজিলের পেশাদার ফুটবল লীগে স্যান্টোসের হয়ে লীগের সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কারটি অর্জন করেন।

বস্তির সেই ছেলেটিকে নিয়ে এবার ইউরোপের বড় বড় ক্লাবগুলো কাড়াকাড়ি শুরু করে দেয়। এদের মধ্যে বর্তমান সময়ের জায়ান্ত রিয়াল মাদ্রিদ, জুভেন্টাসের মতো দলগুলোও ছিল। সবাই-ই যে কোনো মূল্যে পেলেকে তাদের দলে ভেড়াতে দৌড়ঝাপ শুরু করেন। কিন্তু সেবার পেলের ইউরোপে খেলা হয়ে ওঠেনি। কারণটা নিচের কোনো এক জায়গায় জানাবো।

প্রথম ম্যাচেই বিশ্বরেকর্ড
ব্রাজিলের হয়ে পেলের আন্তর্জাতিক ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু হয় চিরপ্রতিদ্বন্ধী আর্জেন্টিনার বিপক্ষে। সময়টা ছিল ১৯৫৭ সালের ৭ জুলাই। সেই ম্যাচে ব্রাজিল আর্জেন্টিনার কাছে ২-১ গোলের ব্যবধানে হেরে গেলেও প্রথম ম্যাচেই বিশ্ব রেকর্ডটি করতে ভুল করেনটি পেলে। ১৬ বছর ৯ মাস বয়সে গোল করে অর্জন করেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতার রেকর্ড।

বিশ্বকাপ ফুটবল
১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে পেলের অভিষেক ঘটে। ম্যাচটি ছিল ১৯৫৮ বিশ্বকাপের তৃতীয় খেলা। ১ম রাউন্ডের খেলায় পেলে গোল করতে না পারলেও অন্তিম মুহূর্তে এসে পেলে ঠিকই জ্বলে উঠেন। কোয়ার্টার ফাইনালের ওই ম্যাচে ওয়েলসের বিপক্ষে পেলের করা গোলে ব্রাজিল সেমিফাইনালের টিকিট নিশ্চিত করে এবং পরবর্তীতে ব্রাজিল স্বাদ পায় প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের। এই গোলটিও ছিল বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড়ের গোল। ১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে জোড়া গোল করে ব্রাজিলের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক বনে যান ১৭ বছর বয়সী পেলে।

এভাবে একে একে ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৬৬ ও ১৯৭০ এর বিশ্বকাপে খেলেন পেলে। এর মধ্যে তিনবার (১৯৫৮, ১৯৬২ ও ১৯৭০) সালে বিশ্বকাপ জয়ের গৌরব অর্জন করেন। তবে পেলে তিনবার বিশ্বকাপ জয় করেছেন নাকি দুইবার বিশ্বকাপ জয় করেছেন তা নিয়ে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত কিছুটা বিতর্ক ছিল। ১৯৬২ সালের বিশ্বকাপে ২য় ম্যাচেই ঘুরুতর আঘাত পান। এই আঘাতই তাকে বিশ্বকাপ দল থেকে ছিটকে দেয়। সেবারও ব্রাজিল বিশ্বকাপ শিরোপা জিতে। তবে পেলে সেই দলের সদস্য কিনা তা নিয়েই চলছিল বিতর্ক। অবশেষে ১৯৯৭ সালে ফুটবলের বিশ্ব সংস্থা ফিফা বিশেষ ব্যবস্থায় তাঁকে ১৯৬২’র বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য ঘোষণা করে।

১৯৬৬ সালের যে বিশ্বকাপটা ব্রাজিল জিততে পারেননি সেই বিশ্বকাপেও ১ম খেলায় বুলগেরিয়ার বিপক্ষে খেলা ম্যাচে পেলে গুরুতর আহত হন।
১৯৭০ সালের বিশ্বকাপে ব্রাজিলের সর্বকালের সেরা দলটির সদস্য হিসেবে পেলে জিতেন তাঁর তৃতীয় বিশ্বকাপ শিরোপা। জুলে রিমে ট্রফিকে নিজের করে নেওয়ার পথে ব্রাজিলের সব সাফল্যের সঙ্গী পেলে ছাড়া বিশ্বের আর কোনো ফুটবলারেরই নেই তিনটি বিশ্বকাপ জয়ের সাফল্য।

১ হাজারেরও অধিক গোল রয়েছে
ক্যারিয়ারের ১৩৬৩ ম্যাচে পেলে গোল করেছেন ১২৮৩টি। ১৯৬৯ সালের নভেম্বরে ভাস্কো-দা-গামা ক্লাবের বিপক্ষে ব্রাজিলিয়ান লিগের এক ম্যাচে যেদিন করলেন তাঁর হাজারতম গোল, সেদিন পুরো ব্রাজিল মেতে উঠেছিল উৎসবে। কোনো একক খেলোয়াড়ের গোল করার ব্যাপারে এটিই ছিল বিশ্বরেকর্ড।

এক ক্লাবেই সম্পূর্ণ ক্যারিয়ার
ক্লাব ফুটবলে পেলের শুরু এবং শেষ স্যান্টোসে। ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১৮ বছরে জিতেছেন ব্রাজিলিয়ান লীগ, কাপ আর আন্তর্জাতিক ক্লাব টুর্নামেন্টের ২৭টি ট্রফি।

তার কারণ হলো – সেবারের ব্রাজিলিয়ান লীগে পেলের পারফরম্যান্স এতটাই নজরকাড়া ছিলো যে, যা স্বয়ং ব্রাজিল সরকারেরও চোখ এড়ায়নি। পেলের এই পারফরম্যান্স তাদের কাছে অমূল্য হিসেবে বিবেচিত হল। তাই তারা আইন করে পেলেকে ব্রাজিলের জাতীয় সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। এই কারণেই ইউরোপিয়ান লীগে পেলের কোনোদিন খেলা হয়নি।

পেলেকে এক নজর দেখার জন্য
অনুমান করুন তো পেলেকে এক নজড় দেখার জন্য আপনি কি কি করতে পারেন। জানি পেলে ভক্তরা তাকে এক নজড় দেখার জন্য অনেক কিছুই করতে পারে। তবে নাইজেরিয়ানরা যেটা করেছিলো সেটা একেবারেই ব্যতিক্রম। কি ছিলো সেটা?
একবার পেলে নাইজেরিয়ায় গিয়েছিলো। সে সময় নাইজেরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলছিলো। শুধুমাত্র পেলেকে দেখার জন্য নাইজেরিয়ার গৃহযুদ্ধে বিবদমান দলগুলো যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করেছিল।

ব্রাজিলের সর্বকালের সেরা খেলোয়াড় পেলে নন
যেখানে সারা বিশ্ব পেলেকে নিয়ে উন্মদনায় মত্ত সেখানে পেলের নিজ দেশ ব্রাজিলে পেলে কিন্তু সর্বকালের সেরা খেলোয়াড় নন। বিরল এই সম্মানটি দেওয়া হয় তিনবার ফর্মুলা ওয়ানজয়ী ‘আয়ারটন সেনা’ কে।

পেলে যেমন ডিয়েগো ম্যারাডোনাকে পাত্তা দিতে চান না, ম্যারাডোনও দু পয়সা দামও দেন না পেলেকে। ফুটবলের সর্বকালের সেরা দুই কিংবদন্তির এই লড়াই চলছেই। সুযোগ পেলেই একে অন্যকে ক্ষতবিক্ষত করেন তাঁরা।

পেলে নাকি ম্যারাডোনা কে সর্বকালের সেরা তা নির্বাচন করার জন্য ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ফিফা ২০০০ সালে একটি ভোটের আয়োজন করেছিল। যেখানে সারা বিশ্বের ফুটবল প্রেমী সাধারণ মানুষ ভোট দেন। সেই ভোটে পেলেকে হারিয়ে সর্বকালের সেরা ফুটবলার হয়েছিলেন ম্যারাডোনা। কিন্তু পরবর্তীতে ফিফা ম্যারাডোনা-পেলে দুজনকেই যৌথভাবে সর্বকালের সেরা ফুটবলার হিসেবে ঘোষণা করেন।

পরবর্তীতে ফিফার এই ঘোষণায় ম্যারাডোনা ফিফার ওপর মনক্ষুন্ন হন এবং তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, সাধারণ মানুষ আমাকেই শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড় নির্বাচন করেছিল। পেলে হয়েছিল দ্বিতীয়। ফিফা পেলেকে যে পুরস্কারটি দিয়েছে, সেটার সে সামান্যতম যোগ্যও নয়।

অসাধারণ ব্যক্তি হিসেবেও পেলের যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। তারই প্রমাণ মেলে, সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে ইউরোপের লিগে খেলার হাতছানি উপেক্ষা করা, অনেক টাকা আয়ের সম্ভাবনারও ঘটেছে অপমৃত্যু কিন্তু সেটা হাসিমুখেই মেনে নিয়েছেন তিনি। পেলে ভুলে যাননি তাঁর নিজের দারিদ্র্ ভরা শৈশবকেও, ব্রাজিলের দরিদ্র শিশুদের সাহায্য করতে খেলোয়াড়ি জীবনেই গড়েছেন বিশেষ ফাউন্ডেশন। আর খেলা ছাড়ার পর কখনো ইউনিসেফের বিশেষ দূত, কখনো জাতিসংঘের জলবায়ুবিষয়ক বিশেষ দূত কখনো বা ব্রাজিলের ‘বিশেষ’ ক্রীড়ামন্ত্রী হিসেবে সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন তাদের সাহায্য করতে।

ফুটবল খেলা থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন বহুদিন হয়ে গেছে। কিন্তু ফুটবলের স্বার্থে শেষ বয়সে এসেও ছুটে ফিরেন বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। অন্যভাবে বলতে গেলে বলা যায়, মাঠের ফুটবলকে বিদায় জানালেও ফুটবল তাঁর ‘রাজা’কে অবসর দেয়নি। তাই পেলে এখনো ফুটবলের সঙ্গেই আছেন, থাকবেন যত দিন বেঁচে থাকবেন।

বিশ্ব একাদশে পেলে
ওয়ার্ল্ড সকার ম্যাগাজিন বিশ্ব একাদশ ফুটবল টিম গঠনের জন্য একটি জরিপ পরিচালনা করে। এই জরিপে সাবেক খেলোয়াড়, কোচ ও সাংবাদিকদের নিয়ে প্যানেল গঠন করে ভোট গ্রহণ করেন। সেই ভোটে বিশ্বের অন্য সব নামী খেলোয়াড়দের পাশাপাশি পেলে নামটিও উঠে এসেছে প্রথম দিকেই।