রাজবাড়ির উত্তরাধিকারী হয়েও আজীবন মেসবাড়ির ঘরে কাটিয়েছেন শিবরাম

মালদা জেলার চাঁচোলের রাজবাড়ির উত্তরাধিকারী হয়েও আজীবন কাটিয়ে দিলেন কলকাতার ১৩৪ নম্বর মুক্তারামবাবু স্ট্রিটে মেসবাড়ির একটা ঘরে। বিয়ে করেননি। একা মানুষ। সাহিত্যের পাশাপাশি করেছেন স্বদেশী…

shibram chakraborty

মালদা জেলার চাঁচোলের রাজবাড়ির উত্তরাধিকারী হয়েও আজীবন কাটিয়ে দিলেন কলকাতার ১৩৪ নম্বর মুক্তারামবাবু স্ট্রিটে মেসবাড়ির একটা ঘরে। বিয়ে করেননি। একা মানুষ। সাহিত্যের পাশাপাশি করেছেন স্বদেশী আন্দোলন। জেল খেটেছেন। জীবন রসিক মানুষ। পিতা শিবপ্রসাদ চক্রবর্তী (Shibram Chakraborty) রাজসম্পত্তির উত্তরাধিকারী হলেও সেসবে তাঁর মন ছিল না।সংসারে থেকেও সন্ন্যাসী। আর মা শিবরানি সারাক্ষণ আধ্যাত্মিক জগতেই থাকতেন।

শিবরামের বাবা ছোটবেলায় শিবরামের বিভিন্ন রকমের বই পড়ার নেশা দেখে খুশি হয়ে বলেছিলেন,’গ্ৰন্থি ভবতি পন্ডিতঃ’– যারা গ্ৰন্থ নিয়ে পড়ে থাকে তারাই পন্ডিত হয়।এই শুনে শিবরামের মা বলেন, ‘ঠিকই বলেছেন তোর বাবা।যারা বই মুখে করে পড়ে থাকে সব সময়,তাদের সবকিছুই পন্ড হয়ে যায়,সেইজন্যই তারা পন্ডিত।’ শিবরামের জীবনদর্শন ও রসবোধ বোধকরি গড়ে উঠেছিল বাড়ির এই পরিবেশেই।

অর্থসংকটে ভুগেছেন সারা জীবন কিন্তু রসবোধ হারাননি কখনও রাবড়িপ্রিয় মানুষটি।শুধু তাঁর সাহিত্য নয়,সমগ্ৰ জীবনটাই একটা রসসাহিত্য।শেষের দিকে শরীরটা ঠিক যাচ্ছিল না।স্মৃতি কমে আসছিল। কথাবার্তা অসংলগ্ন।প্রায়ই বলতেন,’জিনিসপত্র সব বাঁধা হয়ে গেছে এবার একটা ট্যাক্সি পেলেই চলে যাব।’
তাঁর ঘরে গেলে বিস্কুট,লজেন্স টফি,চানাচুর—নিদেনপক্ষে গুঁড়ো দুধ দিয়ে অতিথি সৎকার করতেন বাংলা সাহিত্যে হাসির গল্পের একচ্ছত্র মুকুটহীন সম্রাট শিবরাম চক্রবর্তী৷

মুক্তারামবাবু স্ট্রিটে একটি মেসবাড়িতে বহুকাল কাটিয়েছেন সদা হাস্যময় শিবরাম চক্রবর্তী৷ তিনি ঋণের ফাঁদে পড়েছিলেন, টাকা ধার নিয়েছিলেন এক কাবুলিওয়ালার থেকে৷ টাকার পরিমান দেড়শো টাকা,সুদ প্রতি মাসে পনেরো টাকা৷ প্রথম মাসে সুদ বাবদ টাকা কেটে নেওয়ায় হাতে পেলেন নগদ একশো পঁয়ত্রিশ ৷ শর্ত বেশ কঠিন৷ প্রতি মাসে নির্দিষ্ট তারিখে সুদের টাকা দিতে হবে৷ না হলে কাবুলিওয়ালার হুমকি ছিল মেসে গিয়ে টাকা আদায় করা হবে৷

ওদিকে নিজের খাই -খরচ মিটিয়ে শিবরাম আর কাবুলির খাঁই মেটাতে পারেন না৷কাবুলি রক্তচক্ষু,উগ্র,যেমন গোঁয়ার তেমন গোবিন্দ৷ পালিয়েই বা কতদিন শিবরাম আত্মরক্ষা করবেন৷ দুর্ভাবনায় বুক ধুকপুক থেকে অনিদ্রা৷ চোখের নীচে কাজল৷ শিবরামের মনে বে-ইজ্জত হওয়ার ভয়৷ ঋণ শোধের তাড়নায় শুরু হয়ছিল হাড়-ভাঙা পরিশ্রম,কৃচ্ছ্রসাধন৷ টাকা রোজগারের নানা ফন্দিফিকির৷ বেছে নিয়েছিলেন যেমন সবচেয়ে সহজতম তেমন সম্ভবত বেশ কঠিনতম কাজ! লেখা,লেখা আরও লেখা৷ নানা বিষয়ে নানা ধরনের বিরামহীন লেখা৷ গল্প বেচে,ধার শোধ করে অবশেষে একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারলেন তবে সময় লেগেছিল বেশ কয়েকবছর৷ কাবুলি-আতঙ্কে অনভ্যস্ত হাতে যে কলম তিনি ধরেছিলেন সেই কলমই পরে তাঁর জীবিকার বিশ্বস্ত হাতিয়ার হয়ে উঠল৷

বয়স ভারে জরাজীর্ণ সেই মেস বাড়ির যে ঘরে শিবরাম চক্রবর্তী থাকতেন সে বর্ণনা অনেকেই করেছেন৷ শিবরাম বরাবর একই রঙের জামা পরতেন৷ ঘি রঙের সিল্কের শার্ট,পরনে শান্তিপুরি ধুতি,পায়ে চপ্পল৷ মাঝে-মাঝে ঘড়ি পরতেন৷ বড় সাইজ গোল৷ কাঁটাদুটির খামখেয়ালিতে সঠিক সময় জানতে অন্য ঘড়ি দেখতে হত৷ শীতকালে জামার নীচে সোয়েটার পরে নিতেন,পারা-ওঠা পুরনো আয়নার সামনে সেভ করতেন৷ যাকে বলে প্লেইন লিভিং আর হাই থিংকিং এর এক আদর্শ চরিত্র৷ ঘোর অপছন্দ করতেন প্রণাম করা৷ পায়ে হাত দিলে বাধা দিতেন৷ একবার এক কিশোরী প্রণাম করতে গেলে শিবরাম বলে দিলেন ধুলো মাপার শখ হয়েছে বুঝি! তা পায়ের কেন,তক্তপোশের নীচে যতেষ্ট ধুলো আছে৷ সেই ধুলো মেয়েটির মাথায় ছিটিয়ে বলেছিলেন এবার সে খুশি হয়েছে?

প্রচুর লিখেও তাঁর আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারেন নি,টাকা হাতে এলে খরচ না করা পর্যন্ত স্বস্তি পেতেন না৷ স্ব-রচিত অভাব তাঁর লেগেই থাকত৷ তবে কোনওদিন সেই সব অভাব কে যে একদম পাত্তা দিতেন সদা হাস্যময় শিবরাম চক্রবর্তী৷ আজ সেই শিবরাম চক্রবর্তীর ১২০ তম জন্মদিন।