পঁচিশে মানেই সান্তার দিন, কে এই বুড়ো? জেনে নিন জন্ম বৃত্তান্ত

খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকের শেষের দিকে বর্তমান তুরস্কের ‘মায়রা’ নামক অঞ্চলে ‘নিকোলাস’ নামে এক খ্রিষ্টান ধর্মযাজক ছিলেন।অত্যন্ত কোমলহৃদয়,দয়াপরবশ এই মানুষটি যেকোনো রকম দানের ক্ষেত্রে ছিলেন উদারহস্ত।…

santa clause

খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকের শেষের দিকে বর্তমান তুরস্কের ‘মায়রা’ নামক অঞ্চলে ‘নিকোলাস’ নামে এক খ্রিষ্টান ধর্মযাজক ছিলেন।অত্যন্ত কোমলহৃদয়,দয়াপরবশ এই মানুষটি যেকোনো রকম দানের ক্ষেত্রে ছিলেন উদারহস্ত। কোনো সাহায্যপ্রার্থী কখনো তার দুয়ার থেকে শূণ্য হস্তে ফিরতেন না।ছোটোদের প্রতি তিনি ছিলেন বিশেষ রূপে স্নেহশীল।তার সম্পর্কে প্রচলিত অনেকগুলি গল্পের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়টি হল একদা এক হতদরিদ্র পিতা তার তিন কন্যার বিবাহ দেওয়ার জন্য নূন্যতম কন্যাপণটুকু জোগাড় করতে পারছিলেন না৷

এবং কোনোরকম অন্নসংস্হানের ব্যবস্হা না থাকায় তার কন্যাদের হয়তো গণিকাবৃত্তিতে নামতে বাধ্য হতে হতো জীবিকার তাগিদে,নিকোলাসের কাছে এই সংবাদ পৌঁছালে তিনি অত্যন্ত ব্যথিত হন এবং পরিবারটিকে সাহায্য করতে ছোটেন,কিন্তু প্রচারবিমুখ নিকোলাস চাননি তার সাহায্য করার কথা জনসমক্ষে আসুক,তাই তিনি রাতের অন্ধকারে চুপিচুপি একটি মোহর ভর্তি থলে তাদের জানলা দিয়ে গলিয়ে দেন।অনুরূপ আরোও অনেক ঘটনা তার সম্পর্কে শোনা যায়। মৃত্যুর পর তিনি ‘সেন্ট’ স্বীকৃতি প্রাপ্ত হন এবং তার সম্পর্কিত গল্প,মিথ ছড়িয়ে পরে ইউরোপের অন্যান্য দেশে।পরবর্তীতে কয়েক শতাব্দীর সময়ের স্রোতে,চির গতিশীল ইতিহাসের বিভিন্ন উত্থান-পতনের ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে তা অনেক জায়গা থেকে মুছেও যায়।তবে উত্তর ইউরোপের দেশ নেদারল্যান্ডসে থেকে যায় সেন্ট নিকোলাসের কাহিনী ও সেই সম্পর্কিত মিথ।সেখানকার স্থানীয় ডাচ ভাষায় ‘সেন্ট নিকোলাস’ অপভ্রংশ হয়ে হয় ‘সিন্টার ক্লাস’।তারা ৬ ই ডিসেম্বর সেন্ট নিকোলাসের মৃত্যুদিনটিকে পালন করতে থাকে ‘গিফট গিভিং ডে’ হিসেবে।

   

তবে অনেকের মতে সান্টা ক্লজের উৎপত্তির শিকড় আসলে নিহিত আছে প্রি-ক্রিশ্চিয়ানাইজড ইউরোপের প্যাগান ধর্মবিশ্বাসে,জার্মানিক ও নর্ডিক পুরাণে বর্ণিত উপকথায়। প্রাক-খ্রিষ্টান যুগে উত্তর ইউরোপের দেশগুলিতে শীতের সময় ‘জ্যুলে’ নামক একটি উৎসব উদযাপিত হত।সেখানকার মানুষেরা বিশ্বাস করত যে ওইদিন দেবরাজ ওডিন রাতের বেলায় ঘোড়ায় চড়ে তার পৃথিবীর মানুষকে বর প্রদান করেন। পরবর্তীকালে ইউরোপীয়রা খ্রিষ্ট ধর্মে দীক্ষিত হলেও পূর্বের পৌত্তলিক ধর্মগুলির বহু মিথ,আচার ও বিশ্বাস তাদের জীবনাচরণে রয়ে যায়।

আর তাছাড়া ওই নর্স পুরাণে বর্ণিত দেবতা ‘ওডিন’ ও আজকের ‘সান্টা ক্লজ’ এর দুটি ক্ষেত্রে চমৎকার সাদৃশ্য বর্তমান।(১) উভয়ের দীর্ঘ শুভ্র শ্মশ্রু এবং (২) সান্টা ক্লজের স্লেজ টানে আটটি মেরুহরিণে আর ওডিনের ঘোড়া স্লিপনির এর আটটি পা।এই ভাবে প্রাক-খ্রিষ্টান যুগের লোকাচার ও সেন্ট নিকোলাসের কাহিনী দুই মিশে গিয়ে তৈরী হয় সান্টা ক্লস সম্পর্কিত ধারণা।

এছাড়াও ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রচলিত স্থানীয় লোকগাঁথায় ওইরকম রাতের অন্ধকারে উপহার প্রদানকারীর উল্লেখ পাওয়া যায়।(ইতালিতে ‘লা বেফুনা’,রাশিয়ায় ‘বাব্যুস্চকা’,স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলিতে ‘জ্যুলটোমটেন’)।

Advertisements

বলা যেতে পারে সেন্ট নিকোলাস,সিন্টার ক্লাস,ওডিন ও অন্যান্য আঞ্চলিক ইউরোপীয় লোকবিশ্বাস সবগুলির মিলিত ধারণাই পরবর্তীকালে ‘সান্টা ক্লস’ নামক চরিত্রটির জন্ম দেয়।

আচ্ছা এ তো গেল উৎপত্তির কথা,কিন্তু কী করে তা ছড়িয়ে পড়ল গোটা বিশ্বের শিশুদের মনে,তার বর্তমান রূপ অর্থাৎ লাল সাদা জামা,টুপি,প্রৌঢ় স্থূলকায় দেহ মেরুহরিণে টানা স্লেজ এগুলিই বা এল কোথা থেকে?

সেন্ট নিকোলাস বা ওডিনের গল্প দু-আড়াই হাজার বছর পুরানো হলেও আমরা বর্তমানে সান্টা ক্লস বলতে যেটা দেখি সেটার বয়স দুশো বছরও না।আমেরিকা মহাদেশের আবিষ্কারের পর ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মানুষ ভাগ্যাণ্বেষণের তাগিদে আটলান্টিক পেরিয়ে পাড়ি জমাতে থাকে এই সদ্য-আবিষ্কৃত মহাদেশে।এইভাবে ব্রিটিশ,ডাচ, আইরিশ,স্কটিশ বিভিন্ন কলোনি গড়ে উঠতে থাকে আমেরিকায় এবং তার সাথে সাথে প্রসার ঘটতে থাকে তাদের নিজের নিজের কৃষ্টি,সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের।নেদারল্যান্ডস থেকে আগত ডাচেরা নিউইয়র্ক শহরে সিন্টারক্লাস সম্পর্কিত উৎসব উদযাপন করতে থাকেন ক্রিসমাসের সময়।১৮০৯ সালে ডাচ-আমেরিকান ওয়াশিংটন ইরভিং প্রথম ডাচ সংস্কৃতি ও সিন্টারক্লস সম্পর্কে একটি বইয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করেন।

১৮২৩ খ্রিষ্টাব্দে ক্লিমেন্ট ক্লার্ক নামে এক ব্যক্তি একটি কবিতা লেখেন ‘A visit from st.nicholas’ শিরোনামে,তিনি এটি লিখেছিলেন নিছকই তার সন্তানদের মনোরঞ্জনের জন্য,যদিও কালক্রমে এই কবিতাটির উপরে ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় চরিত্র সান্টা ক্লসের বর্তমান রূপটি।তিনি তার কবিতায় সান্টার শারীরিক বৈশিষ্ট্য ও পোষাকের এবং তার স্লেজ গাড়িটির পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা দেন।
সান্টা ক্লসের স্লেজ গাড়িটি যে আটটি মেরুহরিণ টেনে নিয়ে যায় তাদের নাম হল – ড্যাশার, ড্যান্সার, প্র্যান্সার, ভিক্সেন, কমেট, কিউপিড, ডনর, বিল্টজেন। ২০০৮ সালে কানাডা সরকার ‘সান্টা ক্লস’ কে সাম্মানিক নাগরিকত্ব প্রদান করে।