‘লেখকদের লেখক’ কমলকুমার, সাহিত্যেও করতেন ‘এক্সপেরিমেন্ট’

বিশেষ প্রতিবেদন: তাঁকে বলা হয় ‘লেখকদের লেখক’। তাঁর উপন্যাস ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ এর অনন্যপূর্ব আখ্যানভাগ ও ভাষাশৈলীর জন্য প্রসিদ্ধ। বাঙলা কথাসাহিত্য বিশেষ করে উপন্যাস ইয়োরোপীয় উপন্যাসের…

Kamal Kumar Majumdar

বিশেষ প্রতিবেদন: তাঁকে বলা হয় ‘লেখকদের লেখক’। তাঁর উপন্যাস ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ এর অনন্যপূর্ব আখ্যানভাগ ও ভাষাশৈলীর জন্য প্রসিদ্ধ। বাঙলা কথাসাহিত্য বিশেষ করে উপন্যাস ইয়োরোপীয় উপন্যাসের আদলে গড়ে উঠছিল, কমলকুমার মজুমদার সেই পথ ত্যাগ করেছিলেন। তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের দুরূহতম লেখকদের একজন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তিনি কথাসাহিত্যিক ও শিল্পী কমলকুমার মজুমদার।

তিনি উত্তর চব্বিশ পরগনার জেলার, টাকি শহরে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা-প্রফুল্লকুমার মজুমদার এবং মাতা- রেণুকাদেবী। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিভিন্ন স্থানে কর্মরত ছিলেন। উল্লেখযোগ্য ভাবে, বাংলা সরকারের জনগণনা বিভাগ, গ্রামীন শিল্প ও কারুশিল্প, ললিতকলা একাডেমি এবং সাউথ পয়েন্ট স্কুলে। এছাড়াও তিনি ছবি, নাটক, কাঠের কাজ, ছোটদের আঁকা শেখানো, ব্যালেনৃত্যের পরিকল্পনা, চিত্রনাট্য রচনা করেন। বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর লেখা সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়।

রাধাপ্রসাদবাবু বলতেন, “কমলবাবুর পাণ্ডিত্য যখন-তখন অবাক করে দেবার মতো। কিন্তু সেটা তিনি দেখাতেন না, কথায় কথায় ধরা পড়ত। একটা সেন্স অব হিউমারে সব মুড়ে রাখতেন। একবার হল কী, এক ফড়ফড়ে আঁতেল এসে হাজির কফি হাউজে। নতুন নতুন কী সব বইপত্তর নিয়ে বেজায় বকছে। সদ্য প্রকাশ হওয়া কোন এক আর্ট থিওরির বইয়ের নাম করে বললে, “সে কী, এ বই না পড়া থাকলে তো তিরিশ বছর পিছিয়ে আছেন?”

Kamal Kumar Majumdar

“হঠাৎ বহু ক্ষণ চুপ থাকা কমলবাবু বললেন, ‘আপনার কি অ্যারিস্টটলের ‘পোয়েটিক্স’ পড়া আছে? আঁতেল মাথা নাড়ল, “না, ওটা পড়া নেই।” তাতে ‘এ হে হে’ করে উঠলেন কমলবাবু। বললেন, “তাহলে তো আড়াই হাজার বছর পিছিয়ে গেলেন মোহায়! আঁতেল চুপ।” একদিন বিক্রমনের সঙ্গে বসেছি কমলকুমারের কাছে। এ কথা, সে কথায় বিক্রমন জিজ্ঞেস করলেন, “এত কঠিন করে লেখেন কেন?’ একটু হেসে বললেন, “বলা কঠিন।” তারপর একটু থেমে বললেন, “আমার যে খুব সহজ, তরতরে লেখা পড়তেও কষ্ট হয়, হোঁচট খাই।” বিক্রমন জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার লেখাকে কি বঙ্কিমী ধারায় বলা যাবে?”

কমলবাবু চুপ রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর প্রশ্ন করলেন, “আপনারা কি মার্শাল প্রুস্তের ‘পুরানো সময়ের সন্ধানে’ (ঠিক এই ভাবেই উনি ‘রিমেমব্রেন্স অব থিংগজ পাস্ট’-এর উল্লেখ করেছিলেন) উপন্যাসটির কিছুটাও কি পড়েছেন?” বিক্রমন ও আমি সমস্বরে বললাম, ‘শুধু প্রথম খণ্ড ‘সোয়ানজ ওয়ে’।

কমলবাবু হেসে বললেন, “বাকি সব খণ্ডেও কিন্তু সেই স্মৃতি, স্মৃতি আর স্মৃতি। কখনও কি মনে হয় এত স্মৃতি কি ধরে রাখা যায়? আর এও কি মনে হয়, কীসের প্রভাবে এত কিছু একই মনে ঘর করে? এ সবই শব্দ, বাক্য, সাহিত্যের ইন্দ্রজাল।”

তবে ওঁর প্রথম, প্রধান, অতুলনীয় উপন্যাস ‘অন্তর্জলী যাত্রা’-র শুরু থেকে শেষ যে শ্মশানঘাটে তার প্রথম অনুচ্ছেদটি যেন বিভাস রাগিণীর আলাপসুর। কমলকুমার লিখছেন…“আলো ক্রমে আসিতেছে। এ নভোমণ্ডল মুক্তাফলের ছায়াবৎ হিম নীলাভ। আর অল্পকাল গত হইলে রক্তিমতা প্রভাব বিস্তার করিবে, পূনর্ব্বার আমরা, প্রাকৃতজনেরা, পুষ্পের উষ্ণতা চিহ্নিত হইব। ক্রমে আলো আসিতেছে।” আলো ফুটছে শ্মশানে, যেখানে অশীতিপর সীতারাম চট্টোপাধ্যায়কে অন্তর্জলী যাত্রার জন্য আনা হয়েছে। সেখানে তাঁর সঙ্গে ‘অনিন্দ্যসুন্দর একটি সালঙ্কারা কন্যা’ যশোবতীর বিবাহদানও হল।

<

p style=”text-align: justify;”>লেখাতে কন্যাকে বর্ণনা করেছেন ‘ক্রন্দনের ফলে অনেক স্থানের চন্দন মুছিয়াছে, আকর্ণবিস্তৃত লোচন রক্তাভ, হলুদ প্রলেপে মুখমণ্ডল ঈষৎ স্বর্ণসবুজ। সর্ব্বলক্ষণে দেবীভাব বর্ত্তমান, ফলে সহজেই মনে হইবে এ যেন বা চম্পক ঈশ্বরী, লক্ষ্মী প্রতিমা। শুধুমাত্র মুখখানি জন্ম দুঃখিনীর মতই বিষাদময়।’ এক সময় বৃদ্ধের সঙ্গে যশোবতীর বিবাহ দিয়ে দুজনকে শ্মশানে রেখে চলে গেল সবাই। আশা পর দিন ফেরত এসে বৃদ্ধের মৃত্যু দেখে তাঁর সৎকার ও যশোবতীর সতীদাহ সম্পন্ন করা যাবে। মন মানে না শুধু বৈজু চাঁড়ালের, যার কাজ হবে মড়া পোড়ানো ও সতীকে দাহ করা। সে কেবলই স্বামীর শরীর পাহারা দেওয়া নববধূর কাছে যায় আর বলে, ‘তুমি পুড়বে চচ্চড় করে …ভাবতে আমার চাঁড়ালের বুক ফাটে গো। তুমি পালাও না কেনে।’