Pataliputra: ১ টাকার প্রচার করতেন CPIM বিধায়ক! ১০৭টি গুলি ঢুকেছিল অজিত সরকারের দেহে

প্রসেনজিৎ চৌধুরী: হেলিকপ্টার ঘিরেছে উন্মত্ত জনতা। দেশোয়ালি হিন্দিতে গালাগালির তুবড়ি ছুটছে। সিকিউরিটি অফিসারদের দিকে তাকালেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব। তারপর দরজা খুলে নামলেন। কপ্টারের পাখা…

প্রসেনজিৎ চৌধুরী:

হেলিকপ্টার ঘিরেছে উন্মত্ত জনতা। দেশোয়ালি হিন্দিতে গালাগালির তুবড়ি ছুটছে। সিকিউরিটি অফিসারদের দিকে তাকালেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব। তারপর দরজা খুলে নামলেন। কপ্টারের পাখা ঘোরা তখনও থামেনি। ধুলো উড়ছিল। কাউকে চেনা যাবেনা এমন ধুলো। এই সময় জনতার ভিড়টা ঘিরে নিল মুখ্যমন্ত্রীকে আর নিরাপত্তার রক্ষীদের মেশিনগান ঘুরে গেল জনতার দিকে। এও এক দৃশ্য। পাটলিপুত্রের (Pataliputra) রাজনীতিতে এমন দৃশ্য বিরল।

পূর্ণিয়া জ্বলছিল। রাস্তায় রাস্তায় মোড়ে মোড়ে অবরোধ। যে যেখানে পারছে আগুন ধরাচ্ছে। গোটা দেশ কেঁপে গেছে বিহারের আলোচিত সিপিআইএম বিধায়ক অজিত সরকারকে প্রকাশ্যে খুনের খবরে। ভারতের অন্যতম সাড়া জাগানো রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের পর  পূর্ণিয়া বিচ্ছিন্ন। পশ্চিমবঙ্গের দিকে আসা সব রাস্তা অবরুদ্ধ। পূর্ণিয়া জুড়ে আক্রোশ। পশ্চিমবঙ্গ আশ্চর্য নীরব। রাতের টিভি খবর, রেডিও খবরের পর ইতি উতি আলোচনা অজিত সরকার কে? কেমন নেতা? যার জন্য এত হাহাকার!

পূর্ণিয়ার পরিস্থিতি ভয়াবহ। আগ্রাসী ভিড় যদি ঝাঁপিয়ে পড়ে তাহলে সিএমের সিকিউরিটি দেওয়া সম্ভব নয়। এটা বুঝে গেলেন সরকারি কর্তারা। তবে সেই তেড়ে আসা ভিড় শান্ত হয়েছিল নিহত অজিত সরকারের ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে লালুপ্রসাদ হাতজোড় করতেই।

Lalu Prasad

“आँख खुली तो देखा घर में कोई नहीं था
हाथ लगाकर देखा तो तन्नूर अभी तक बुझा नहीं था”- গুলজার

১৯৯৮ সালের ১৪ জুনের রক্তাক্ত সন্ধে বিহারকে যে বিতর্কের মুখে ফেলে দিয়েছে, তা এখনো তীব্র আলোচিত। সেই সন্ধে নাগাদ পূর্ণিয়াবাসীর ‘অজিত দা’ অভ্যাসবশত এলাকায় ঘুরছিলেন। সঙ্গী দলীয় কর্মী আসফাকুর রহমান ও গাড়ি চালক হরেন্দ্র শর্মা। তখনই ঘিরে ধরে কয়েকজন। তারপর শুধু গুলির শব্দ। সেই মুহূর্তেই পূর্ণিয়া বিহারের রক্তাক্ত ‘বন্দুক ও সিন্দুক’ রাজনীতির একেবারে চিরচর্চিত নাম হয়ে গেলেন সিপিআইএম বিধায়ক অজিত সরকার।

অজিত সরকার বিহারের মাফিয়াদের কাছে ত্রাস। তার এক নির্দেশে শ’য়ে শ’য়ে মানুষ ঘেরাও করে। জমির দখল মুক্ত হয়। সেই জমিতে শুরু হয় চাষ-বাস। এমনই নেতা অজিত সরকার। নেতার নামেই ভোট। সিপিআইএম তরতরিয়ে ১৯৮০ সাল থেকে পূর্ণিয়া আসনে জয় পাচ্ছিল।  পশ্চিমবঙ্গের কোনও এক রাস্তার ধারে, কোথাও তাকে চা খেতে দেখা যেত। কে চেনে! সিপিআইএমের রাজত্বে এসে নিজেকে গুটিয়ে রাখতেন সিপিআইএমেরই বিহারি বিধায়ক অজিত সরকার!

পূর্ণিয়া বিহারের সীমাঞ্চল এলাকা। এর সঙ্গে আছে পশ্চিমবঙ্গের সীমানা। প্রতিবছর বন্যা স্বাভাবিক ঘটনা। অজিত সরকার অতি সক্রিয় সামন্তবাদকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে জমির আন্দোলনে নেতা হিসেবে দ্রুত উঠে আসছিলেন। নির্বাচনে পরপর জয় যেন ছিল নিয়ম। এই সময়েই আবির্ভাব পাপ্পু যাদবের। পূর্ণিয়ার দখল নিতে লালুপ্রসাদের ঘনিষ্ঠ পাপ্পু (রাজেশ রঞ্জন) ‘জান ‘ লড়িয়ে দেয়। কিন্তু সব লড়াই শেষ হয় অজিত সরকারের কাছে এসে।

বিহারের ভোট আসছে।  সব দল প্রচারে ব্যাস্ত। পূর্নিয়ায় সিপিআইএম তেমন প্রচারে নেই।  শুধু কয়েকটা মিটিং। তবে একটা চমক থাকত। পূর্ণিয়ার বাজারে লাল গামছা পেতে রেখে ‘এক রুপয়ে’ দেওয়ার আহ্বান করতেন ‘বিধায়কজি’ অজিত সরকার। দিন শেষে গামছা খুলে কত টাকা জমা পড়ল তার হিসেব থেকেই ভোট পাওয়ার আন্দাজ মিলিয়ে নিতেন। অজিত সরকারের টাফ রাজনীতির আন্দাজ পাওয়া মুশকিল।

ভাড়া বাড়িতে থেকে এই একলা ‘বাম বিপ্লবী’ বুঝেছিলেন জমির লড়াইয়ের আসল কথা। প্রতিদ্বন্দ্বী পাপ্পুর এখানেই ঘাটতি। পূর্ণিয়া কব্জা করতে সিন্দুক খুলে আহ্বান জানায় জমিদার গোষ্ঠী। টাকা ওড়ে বিস্তর। কিন্তু ভোটের দিন সব ভোজবাজি। বুথে বুথে জামানত বাজেয়াপ্ত হয় পাপ্পু যাদবের। বিহারের অতি আলোচিত জাতিবাদ রাজনীতি এসে ঠোক্কর খায় অজিত সরকারের কাছে। ১৯৮০-১৯৮৯ টানা ১৮ বছর এভাবেই বিধায়ক।

হিটলিস্টে নাম ওঠার পর গুলিতে ঝাঁঝরা অজিত সরকারের দেহ সরকারি গাড়ির মধ্যে পড়েছিল। পাপ্পু যাদবকে গ্রেফতারের দাবিতে উত্তাল পূর্ণিয়ায় লালুপ্রসাদ আসলেন। চাপে পড়ে ঘনিষ্ঠ পাপ্পুর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরুর ‘ওয়াদা’ করলেন। তদন্ত শুরু হল। গ্রেফতার হয় পাপ্পু যাদব, রাজন তিওয়ারি ও অনিল কুমার যাদব। আট বছর জেল খাটে পাপ্পু।

সিপিআইএম নেতা অজিত সরকার খুনের পর তাঁর স্ত্রী মাধবী সরকার সহানুভূতির হাওয়ায় জয়ী হন পূর্নিয়া থেকে। পরে সিপিআইএমের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে তিনি যোগ দেন অতি বাম সংগঠন সিপিআই(এম-এল) দলে। আর জিততে পারেননি। ততদিনে পাপ্পু যাদবের দখলে চলে গেছে পুরো পূর্ণিয়া। এখন শুধু রাস্তার ধারে একটা মূর্তি। মৃত্যুর দিন স্মরণে রেখে ফুলে ঢেকে যায় অজিত সরকারের মূর্তি। পূর্ণিয়ার গরীব চাষী, কুলিরা আসেন প্রণাম করতে। তারাই বলেন ‘এক থা মসিহা’। অজিতদার দলে নয়, তবে ভোট পড়ে অন্য চিহ্নে!

ময়না তদন্তে  লেখা আছে, অজিত সরকারের দেহে ১০৭টি গুলি ঢুকেছিল। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতামত, ‘মসিহা’-কে খতম করতে এতটাই নিশ্চিত হতে চেয়েছিল খুনিরা। (চলবে)

গত পর্বPataliputra: হা হা হা…হাসছে ডন শাহাবুদ্দিন, ভয়ে দৌড়চ্ছে পুলিশ, জেএনইউর চন্দু কিন্তু লড়ল