প্রসেনজিৎ চৌধুরী: দীর্ঘ ভোট রাজনীতি থেকে সরে গেলেন ত্রিপুরার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও বর্তমান বিরোধী দলনেতা তথা সিপিআইএম (CPIM) পলিটব্যুরো সদস্য (Manik Sarkar) মানিক সরকার। বিধানসভা ভোটে তিনি আর লড়াই করছেন না।
টানা কুড়ি বছরের মুখ্যমন্ত্রী থেকে বিরোধী দলনেতার পদমর্যাদা নিয়ে তিনি সংসদীয় রাজনীতি থেকে চিরতরে সরে গেলেন। এ যেন নীরবে অবসরে চলে যাওয়া। যদিও কমিউনিস্টরা মনে করেন যতদিন জীবন ততদিন লড়াই। মানিক সরকার ভারতের শীর্ষ কমিউনিস্ট নেতা। তিনি ভোট লড়াই থেকে সরে গেলেও রাজনৈতিক মতাদর্শগত লড়াইতে থাকছেন।
মানিক সরকার থেকে মানিকবাবু হয়েছিলেন কি হননি তার উত্তর খোঁজা মুশকিল। কারণ, রাজনৈতিক গাম্ভীর্যের অন্তরালে তাঁর মত রাশভারি বাম রাজনীতিক অনেকে আছেন ও থাকবেন তবে মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে সরে যাওয়া ও ত্রিপুরার বিরোধী দলনেতার পদে আসার পর সিপিআইএমের শীর্ষ নেতা মানিক সরকারকে যতবার হাটুরে রাস্তায়, রাজপথে, গ্রামে, সীমাম্ত এলারায় দৃপ্ত পদচারণায় দেখা গেছে তখন রীতিমত বাক্যবান ছুটিয়েছেন। সাদা পোশাকের মানিক সরকারের গলায় লাল মাফলার, চোখে কঠিন দৃষ্টি এ ছবি গত পাঁচ বছর ত্রিপুরার রাজনৈতিক সংঘর্ষ কবলিত এলাকা থেকে বারবার সামাজিক গণমাধ্যমে উঠে এসেছিল। এ রাজ্যে গত বিধানসভা ভোটের সময় পুরো দেশ জুড়ে আলোচিত ছিলেন গরিব মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার। যিনি সন্ত্রাসবাদের বিষদাঁত ভেঙে দিয়েছিলেন। রক্তাক্ত ত্রিপুরা হয়েছিল ঠাণ্ডা।
ত্রিপুরার রাজনীতিতে কমিউনিস্ট শক্তি স্বাধীনতার আগে থেকেই শিকড় ছড়িয়েছিল। রাজন্য ত্রিপুরা থেকে ভারতের অঙ্গরাজ্য হয়ে যাওয়া এই ছোট্ট ভূখণ্ডের পার্বত্য এলাকায় উপজাতি জণগণকে এক করে কমিউনিস্ট শক্তির উত্থান। সেই উত্থানের তিন নায়ক দশরথ দেববর্মা, বীরেন দত্ত ও নৃপেণ চক্রবর্তী। রাজনৈতিক ঘাত প্রতিঘাতে ত্রিপুরায় প্রথমবার কমিউনিস্ট শাসন শুরু হয় ১৯৭৮ সালে। নৃপেন চক্রবর্তী ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই রেশ ধরে পরবর্রতী সময়ে কখনও কংগ্রেস ও কখনও কমিউনিস্ট শাসনের মধ্যে সরকার পরিবর্তন হয়েছে ত্রিপুরায়।
রাজন্য ত্রিপুরায় উপজাতিদের নিয়ে আন্দোলনের কিংবদন্তি নেতা দশরথ দেববর্মা মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন ১৯৯৩ সালে। তিনি প্রয়াত হন ১৯৯৮ সালে। দশরথ পরবর্তী সময়টি ছিল মানিক সরকারের। ১৯৯৮ থেকে টানা ২০১৮ সাল নিজের কুড়ি বছর ও বামফ্রন্ট সরকারের পঁচিশ বছর সময়ের বড় অংশটিতে মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন মানিক সরকার। গত বিধানসভা ভোটে ত্রিপুরায় যখন বাম দুর্গ ভেঙে পড়ছিল তখনও সেই যুদ্ধে নিজের কেন্দ্র ধনপুর থেকে জয়ী মানিক সরকার। ফলাফল ঘোষণার পরই রাজনৈতিক সংঘাতের মাঝে পরিস্থিতি নিমন্ত্রণে রাখার নির্দেশ দিয়েই পদত্যাগ পত্র রাজ্যপালের হাতে তুলে দেন তিনি। শেষ হয়েছিল ত্রিপুরার মানিক জমানা।
বিরোধী দলনেতা হিসেবে অন্য মানিককে দেখল ত্রিপুরা সহ দেশ। তিনি আটপৌরে এক মানুষ। যিনি রাজপথে নেমে দলীয় কর্মীদের সাথে ব্যারিকেড ভাঙেন। তিনিই আবার বিরোধী নেতা হয়ে বিধানসভায় ভাষণ দিলে সরকারপক্ষ মেনে নেয় ‘আপনার অভিজ্ঞতা’ অসীম। এই মানিক দেখিয়ে দিয়েছেন ভোটের পরাজয় মানে ঘর ঢুকে যাওয়া নয়। রাজপথে দাঁড়িয়ে রাজনীতি করা। যেমনটা করেননি পশ্চিমবঙ্গে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। এ যেন এক শিক্ষা দান। সেই শিক্ষাই দিয়ে সংসদীয় রাজনীতি থেকে অবসরে চলে গেলেন মানিক সরকার।