রাজধানী দিল্লি গত রবিবার তীব্র তাপপ্রবাহের কবলে পড়েছে, যখন এই মরশুমে প্রথমবারের মতো তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (Delhi heatwave) ছাড়িয়েছে। ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগ (আইএমডি) জানিয়েছে, দিল্লির প্রধান আবহাওয়া কেন্দ্র সফদরজং-এ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪২.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যেখানে পালাম স্টেশনে তাপমাত্রা ছিল ৪২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। জাতীয় রাজধানী অঞ্চল (এনসিআর)-এর নয়ডা, গুরুগ্রাম সহ অন্যান্য এলাকাও এই তীব্র গরমের কবলে রয়েছে। নয়ডায় তাপমাত্রা ৪১.৫ ডিগ্রি এবং গুরুগ্রামে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। আইএমডি-র পূরভাষ অনুযায়ী, এই তাপপ্রবাহ আগামী সপ্তাহ পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে, যার ফলে বাসিন্দাদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
বিভিন্ন এলাকায় রেকর্ড তাপমাত্রা
রবিবার দক্ষিণ দিল্লির আয়া নগরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪৪.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা শহরের অন্যান্য অংশের তুলনায় সবচেয়ে বেশি। লোদি রোডে তাপমাত্রা ছিল ৪২.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সেন্ট্রাল রিজ এলাকায় ৪২.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই উচ্চ তাপমাত্রা শহরে তাপপ্রবাহের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। উচ্চ আর্দ্রতার কারণে এই গরম আরও অসহনীয় হয়ে উঠেছে, যা বাসিন্দাদের দৈনন্দিন জীবনকে কঠিন করে তুলেছে। এনসিআর-এর অন্যান্য শহর যেমন নয়ডা, গুরুগ্রাম, গাজিয়াবাদ এবং ফরিদাবাদেও একই ধরনের তীব্র গরম অনুভূত হচ্ছে। আইএমডি-র তথ্য অনুযায়ী, এই অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে।
আইএমডি-র হলুদ সতর্কতা
তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে আইএমডি আগামী চার দিনের জন্য দিল্লি এবং এনসিআর অঞ্চলের জন্য হলুদ সতর্কতা জারি করেছে। এই সতর্কতা বাসিন্দাদের তাপজনিত অসুস্থতা এড়াতে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করার পরামর্শ দিয়েছে। আইএমডি জানিয়েছে, দিনের তাপমাত্রা ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে, এবং উচ্চ আর্দ্রতার কারণে গরমের তীব্রতা আরও বাড়বে। রাতের তাপমাত্রাও উষ্ণ থাকবে, যার ফলে দিনের তীব্র গরম থেকে তেমন কোনো স্বস্তি মিলবে না। আইএমডি-র পূরভাষ অনুযায়ী, বৃহস্পতিবারের আগে তাপমাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমার কোনো সম্ভাবনা নেই।
এক্স-এ প্রকাশিত পোস্টে দেখা গেছে, দিল্লির বাসিন্দারা এই তীব্র গরমের কারণে হাঁসফাঁস করছেন। একটি পোস্টে বলা হয়েছে, “দিল্লিতে তাপমাত্রা ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁয়েছে, এবং আগামী কয়েকদিন এই গরম থেকে কোনো স্বস্তি নেই।” আরেকটি পোস্টে বলা হয়েছে, “তীব্র গরম এবং আর্দ্রতার কারণে বাইরে বের হওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে।” এই পোস্টগুলো দিল্লির বর্তমান আবহাওয়ার প্রতি মানুষের ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করছে।
সপ্তাহের শেষে ঝড়-বৃষ্টির সম্ভাবনা
তবে, আশার আলো হিসেবে আইএমডি জানিয়েছে, সপ্তাহের শেষে বৃহস্পতিবারের পর থেকে ঝড়-বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে, যা তীব্র তাপপ্রবাহ থেকে কিছুটা স্বস্তি আনতে পারে। পশ্চিমী ঝঞ্ঝার প্রভাবে দিল্লি এবং এনসিআর অঞ্চলে হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি এবং বজ্রপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এই বৃষ্টি তাপমাত্রা কিছুটা কমিয়ে তাপপ্রবাহের তীব্রতা হ্রাস করতে পারে। আইএমডি-র বিজ্ঞানী কুলদীপ শ্রীবাস্তব বলেন, “ঝড় এবং বৃষ্টির কারণে তাপমাত্রা ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে নেমে আসতে পারে।” তবে, বৃষ্টির পর তাপমাত্রা আবার বাড়তে পারে বলেও সতর্ক করা হয়েছে।
তাপমাত্রার ক্রমবর্ধমান প্রবণতা
জুন মাসের শুরুতে দিল্লির তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে মৃদু ছিল। গত শুক্রবার, ৭ জুন, সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৮.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা মরশুমের গড়ের তুলনায় কিছুটা কম। কিন্তু ৫ জুন থেকে তাপমাত্রা ক্রমাগত বাড়ছে, এবং এখন দিল্লি এই মরশুমের প্রথম গুরুতর তাপপ্রবাহের মুখোমুখি। আইএমডি-র তথ্য অনুযায়ী, তাপপ্রবাহ তখনই ঘোষণা করা হয় যখন তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়ায় এবং স্বাভাবিকের তুলনায় ৪.৫ থেকে ৬.৪ ডিগ্রি বেশি থাকে। বর্তমানে দিল্লির তাপমাত্রা এই মানদণ্ড পূরণ করছে, যা শহরের জন্য উদ্বেগজনক।
তাপপ্রবাহের প্রভাব এবং সতর্কতা
তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে দিল্লির বাসিন্দারা বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। উচ্চ তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতার ফলে হিটস্ট্রোক, ডিহাইড্রেশন এবং অন্যান্য তাপজনিত অসুস্থতার ঝুঁকি বেড়েছে। বিশেষ করে শিশু, বয়স্ক ব্যক্তি এবং দীর্ঘ সময় বাইরে কাজ করা শ্রমিকদের জন্য এই পরিস্থিতি বিপজ্জনক। আইএমডি বাসিন্দাদের পর্যাপ্ত পানি পান, হালকা রঙের পোশাক পরা এবং দুপুরের তীব্র রোদে বাইরে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। এছাড়া, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি এবং শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় দিল্লিতে বিদ্যুৎ চাহিদাও রেকর্ড স্তরে পৌঁছেছে। গত শুক্রবার দিল্লির বিদ্যুৎ চাহিদা ৬,৮৬৭ মেগাওয়াটে পৌঁছেছিল, এবং এই গ্রীষ্মে এটি ৯,০০০ মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাব
তীব্র তাপপ্রবাহ শুধুমাত্র শারীরিক স্বাস্থ্যের উপরই প্রভাব ফেলছে না, বরং পরিবেশ এবং সামাজিক কাঠামোর উপরও এর প্রভাব পড়ছে। দিল্লির বায়ুর গুণমান সূচক (একিউআই) বর্তমানে ‘দরিদ্র’ বিভাগে রয়েছে, যা তাপপ্রবাহ এবং ধুলোর কারণে আরও খারাপ হচ্ছে। উচ্চ তাপমাত্রার কারণে শ্রমিক, রাস্তার বিক্রেতা এবং নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, দিল্লির রাস্তার বিক্রেতারা তাপপ্রবাহের কারণে আয় হ্রাস এবং স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন।
দিল্লি এবং এনসিআর অঞ্চল বর্তমানে তীব্র তাপপ্রবাহের কবলে রয়েছে, যা বাসিন্দাদের জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তুলেছে। আইএমডি-র হলুদ সতর্কতা এবং আগামী বৃহস্পতিবার থেকে ঝড়-বৃষ্টির পূরভাষ এই পরিস্থিতি থেকে কিছুটা স্বস্তি আনতে পারে। তবে, তাপমাত্রা পুনরায় বাড়ার সম্ভাবনা থাকায় সতর্কতা অবলম্বন করা অত্যন্ত জরুরি। প্রশাসনের উচিত তাপপ্রবাহ মোকাবিলায় জনসচেতনতা বাড়ানো, পানীয় জলের ব্যবস্থা করা এবং বিশেষ করে দুর্বল জনগোষ্ঠীর জন্য সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করা। দিল্লির বাসিন্দারা এখন আশায় রয়েছেন যে সপ্তাহের শেষে বৃষ্টি তাদের কিছুটা স্বস্তি দেবে, তবে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের এই তীব্র গরমের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।