বাংলার নির্বাচনের ইতিহাসের পাতায় শুধু রক্তে-মাখা সন্ত্রাসের কঠিন বাস্তব…

বঙ্গে নির্বাচন হলেই হিংসা এবং সন্ত্রাসের সাক্ষী থেকেছে এই বাংলা। ভয়াবহ পরিস্থিতি প্রায় প্রতিবারই। নির্বাচন এলে শুধু ঝরে কতগুলি তরতাজা প্রাণ। ঠিক যেন মনে হয়…

বঙ্গে নির্বাচন হলেই হিংসা এবং সন্ত্রাসের সাক্ষী থেকেছে এই বাংলা। ভয়াবহ পরিস্থিতি প্রায় প্রতিবারই। নির্বাচন এলে শুধু ঝরে কতগুলি তরতাজা প্রাণ। ঠিক যেন মনে হয় রক্তে রাঙা হোলি উৎসব। বছর-বছর ভোট আসে আর যায়…শুধু আজও তাজা ভোট সন্ত্রাসে প্রাণ হারানো মানুষের রক্ত।

রাজ্যে রাজনৈতিক শত্রুতা এবং সন্ত্রাসের ইতিহাস বহু পুরনো। পঞ্চায়েতের দিন ঘোষণার পর থেকে এখনও অবধি এখনও অবধি প্রাণ গিয়েছে ১৪ জনের। আগামী ৮ জুলাই ভোট। কোথাও তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দের অভিযোগ তো কোথাও টিএমসি-আইএসএফ কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ। কোথাও আবার তৃণমূল-বিজেপি তুমুল লড়াই। সব মিলিয়ে শরগরম রাজ্য।

   

নির্বাচনের সময়ে রাজনৈতিক হিংসা এতটাই হিংস্র হয়ে উঠে যে অনেক সরকারী কর্মী পোল ডিউটির ভয়ে নমিনেশন ফাইল করে ফেলেছেন। ভোট ডিউটিতে সন্ত্রাসের ভয় থেকেই এই সিদ্ধান্ত। এমনটাই জানা গিয়েছে The Wire এর প্রতিবেদন থেকে।

রাজনৈতিক সন্ত্রাসের আঁতুড়ঘর বীরভুম। সেখানে দেখা যাচ্ছে যে রাজনৈতিক প্রার্থীর থেকেও বেশি নির্দল প্রার্থী। কেন এমন? The Wire এর প্রতিবেদনে এক স্থানীয় তৃণমূল নেতাকে উদ্ধৃত করা হয়েছে। তিনি বলেছেন যে নির্বাচনের ফলাফলে যখন দুই দলের মধ্যে চলছে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই, তখন একটা-দুটো ভোট নষ্ট করলেই তা প্রভাব ফেলবে ফলাফলের উপর। তিনি আরও বলেন যে তারা খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছেন যে সমস্ত নির্দল প্রার্থী আসলে স্কুল শিক্ষক। তারা জানিয়েছেন যে তারা পোল অফিসার হতে চান না বলেই নির্দল হয়ে নমিনেশন ফাইল করেছেন। তারা প্রচারও করবেন না, আবার কোনও ভোটও চাইবেন না।

গত পঞ্চায়েতে স্কুল শিক্ষক রাজকুমার রায়কে উত্তর দিনাজপুরে প্রিসাইডিং অফিসার হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। তিনি নিরাপত্তা এবং ভোট গ্রহণের প্রক্রিয়া নিয়ে বারবার প্রশ্ন তোলেন। ভোট শেষ হতেই নিখোঁজ হয়ে যান। পরে ভোট কেন্দ্র থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে সোনাডিঙ্গীতে তাঁর দেহ পাওয়া যায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয় তাঁর পরিবারকে এবং তাঁর স্ত্রী অর্পিতাকে চাকরি। সন্তানদের পড়াশোনার দায়িত্ব নেয় রাজ্য সরকার। তবে The Wire এর সাংবাদিক এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী তা আজ অবধি সরকার করেনি।

এই বারের গ্রাম-বাংলার ভোটের আগেই চলে গিয়েছে রায়গঞ্জের ২১ বছরের মঞ্জুর আলমের প্রাণ। সিপিআই(এম)এর প্রার্থী হয়ে মনোনয়ন জমা দিতে যাচ্ছিল মঞ্জুর। তৃণমূলের আশ্রিত দুস্ক্রতীদের আক্রমণে গুরুতর হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ৯ জন। প্রাণ হারান মঞ্জুর আলম। সন্তানকে হারিয়ে শোকাহত মা অর্জুনা খাতুন জানিয়েছেন ঘটনার দিন সকালে খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে মায়ের কাছে বলতে এসেছিল মঞ্জুর মনোনয়ন জমা দিতে যাওয়ার কথা। সকালে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে খেয়ে তারপর দলীয় পতাকা নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে মনোনয়ন দাখিল করতে। সেদিন মঞ্জুর বাড়ি ফিরল কফিনে। মায়ের কোল শূন্য করেছে যাঁরা, তাদের চরম শাস্তি চায় এই অভাগী মা।

২০১৮ সালের পঞ্চায়েতে্র সময় রাজনৈতিক হিংসায় প্রাণ গিয়েছিল ৩০ জনের। নির্বাচনের দিনই ১২ জন ভোট-সন্ত্রাসের বলি হয়েছিলেন। মুর্শিদাবাদে শাহিন শেখ, এক নির্দল প্রার্থীর আত্মীয়কে গুলি করে মেরে ফেলার অভিযোগ রয়েছে তৃণমূল আশ্রিত দুস্কৃতীদের বিরুদ্ধে। শাহিন ‘বুথ ক্যাপচার’ থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিল সেদিন। ছয় বছর কেটে গিয়েছে, আজও তার স্ত্রী ঘটনার কথা ভাবলেই ডুকরে কাঁদেন।
ভোট সন্ত্রাস নিয়ে The Wire-কে তৃণমূল দলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেন, “প্রত্যেকটি ঘটনা যেখানে কোন দলের কর্মীর প্রাণ গিয়েছে, দল তার পরিবারের সঙ্গে আছে এবং সবসময় থাকবে।“ সিপিআই(এম) সেন্ট্রাল কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী জানান যে দল পরিবারের পাশে দাঁড়ায়, অর্থ সাহায্য করে এবং সন্তানদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করে।

২০১৮-র পঞ্চায়েতে কাকদ্বীপের ঘটনায় আজও শিহরিত সকলেই। ১৮ বছরের দিপঙ্কর দাস রাতে বাড়ি ফিরে দেখে তার বাবা-মা পুড়ে ছাঁই হয়ে পড়ে রয়েছে। দেবু-ঊষার সঙ্গে গোটা বাড়িও পুড়ে ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়। দেবু-ঊষা বাম সমর্থক ছিল বলেই জানা গিয়েছে। ৫ দিনের টানাপোড়েনের পর দিপঙ্কর তার বাবা-মায়ের দেহ পায় পুলিশের থেকে।

সকলের চোখ ৮ জুলাই। অনেক টানাপোড়েনের পর কেন্দ্র থেকে বাকি কেন্দ্রীয় বাহিনীর রেকুইজিশন মঞ্জুর করেছে।

কেন্দ্রীয় বাহিনীর কড়া নিরাপত্তায় ভোট হবে। শান্তিপূর্ণ ও অবাধ ভোট কি হবে ৮ তারিখ? ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে শান্তিপূর্ণ ভোট নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।