বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে হওয়া অত্যাচারের খবর গত কিছু দিন ধরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। এই পরিস্থিতি এমন এক সময় ঘটেছে যখন প্রতিবেশী দেশের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অস্থিরতা পশ্চিমবঙ্গে কেমন করে প্রভাব ফেলতে পারে, সে নিয়ে নানা ধরনের উদ্বেগ প্রকাশিত হচ্ছে। তীব্র প্রতিবাদ এবং রাজনৈতিক মহলে উত্তেজনার পারদ চড়ছে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে এর প্রভাব কতটুকু হবে তা নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। এই পরিস্থিতিতে এক পক্ষে জনগণের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ তৈরি হচ্ছে, আবার অন্য পক্ষে কিছু রাজনৈতিক দল এই ঘটনাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চাচ্ছে।
এই সংকটময় মুহূর্তে, পশ্চিমবঙ্গের যুব তৃণমূল নেতা দেবাংশু ভট্টাচার্য (Debangshu Bhattacharya) স্যোসাল মিডিয়ায় পোস্ট করে তাঁর বক্তব্যে যথেষ্ট সতর্কতা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে যে অত্যাচার হচ্ছে, তা অবশ্যই নিন্দনীয়। তবে আমাদের সকলের উচিত এই পরিস্থিতি থেকে কোনো ধরনের মেরুকরণের সুযোগ না পাওয়া।” তাঁর মতে, এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে পশ্চিমবঙ্গের শান্তি ও সাম্প্রদায়িক ঐক্য অটুট রাখা হোক এবং প্রতিবেশী দেশের পরিস্থিতি আমাদের এখানে কোনোভাবেই উত্তেজনা বা বিশৃঙ্খলা তৈরি না করুক।
দেবাংশুর এই সতর্কবার্তা পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক মহলে নানা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। তাঁর মন্তব্যটি অনেকেরই প্রশংসা পেয়েছে, কারণ তিনি রাজ্যের পরিস্থিতি সম্পর্কে অতি বাস্তবভাবে ভাবছেন। তিনি আরও বলেন, “আমরা যদি পার্শ্ববর্তী বাড়ির আগুন দেখে নিজেকে ন্যূনতম দূরত্বে রাখি, তবে ভালো হয়। সেটা না হলে আমাদের নিজেদের ঘরও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে।”
প্রধানত, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অত্যাচারের ঘটনায় ভারতের প্রতিবাদ একদিকে যেমন দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, তেমনি রাজনৈতিক দলগুলোও এ সুযোগে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করতে এগিয়ে এসেছে। পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী রাজনৈতিক দল বিজেপি, যাদের মূল শক্তি হিন্দুত্ববাদী চিন্তাধারা, তারা এই ইস্যুতে ক্রমাগত কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। তারা এই বিষয়টিকে ভোটব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে এবং পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি করতে চাইছে।
তবে দেবাংশু ভট্টাচার্য আরও বলেন, “এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, রাজ্যের শান্তি বজায় রাখা। পশ্চিমবঙ্গের জনগণ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং শান্তির পক্ষে।” রাজ্যের বিভিন্ন হিন্দু সংগঠনও বাংলাদেশে হিন্দুদের প্রতি অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে, কিন্তু দেবাংশু তাদের প্রতি সতর্ক বার্তা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “আমাদের প্রতিবাদ অবশ্যই শান্তিপূর্ণ ও যুক্তিযুক্ত হতে হবে। কোনো ধরনের উত্তেজনা বা সহিংসতা রাজ্য বা দেশের পরিবেশকে আরও জটিল করে তুলবে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক সঞ্জয় মল্লিক জানান, পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে রাজনৈতিক মেরুকরণ একটি পুরনো প্রবণতা। বিশেষত, ২০১১ সালের পর, যখন তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসে, রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি একেবারে নতুন মোড় নেয়। তবে, বাংলাদেশের পরিস্থিতি পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতির ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে এমন এক সময় যখন রাজ্যে একে অপরের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলি নিজেদের অবস্থান আরো জোরদার করার চেষ্টা করছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের প্রতি অত্যাচারের ঘটনা শুধুমাত্র সাম্প্রদায়িক ইস্যু তৈরি করতে সহায়ক হতে পারে না, বরং তা রাজ্যে শান্তিপূর্ণ পরিবেশের ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকেও বারবার জানানো হয়েছে যে, তারা ধর্মীয় বিভাজন নয়, বরং মানুষের ঐক্য ও সমৃদ্ধির পক্ষে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এই বিষয়ে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। তিনি বলেছেন, “যে দেশে সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার হচ্ছে, সেখানে আমাদের নিশ্চুপ থাকলে চলবে না। তবে রাজ্যে কোনোভাবেই আমাদের সমাজকে বিভাজন করার সুযোগ দেওয়া যাবে না।”
এই পুরো পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে, পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষ এখন শুধুমাত্র প্রতিবাদ জানাতে চাইছে না, তারা রাজ্যের শান্তি এবং নিরাপত্তার প্রশ্নেও গভীরভাবে চিন্তিত। রাজ্য সরকার এবং রাজনৈতিক নেতারা যদি এই সংকটময় মুহূর্তে যথাযথ পদক্ষেপ নেন এবং রাজ্যের জনগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি বজায় রাখেন, তবে পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যত পরিস্থিতি সবার জন্যই ভাল হতে পারে।
কিন্তু সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, এই সঙ্কটের মধ্যে কেউ যেন রাজনৈতিক সুবিধা নিতে না পারে, আর সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের নির্যাতন বা ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা না বৃদ্ধি পায়। পশ্চিমবঙ্গে একটি শান্তিপূর্ণ, সহনশীল সমাজ গড়ে তোলার জন্য এই ধরনের সমস্যা থেকে দূরে থাকতে হবে এবং মেরুকরণ এড়িয়ে চলতে হবে।
বাংলাদেশের পরিস্থিতি পশ্চিমবঙ্গে উত্তেজনা তৈরি করলেও, দেবাংশু ভট্টাচার্যের পরামর্শ অনুযায়ী, আমাদের উচিত সতর্ক থাকা এবং শান্তি বজায় রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা করা।