ট্রেন চাপা দিয়ে বেগুনকোদরের ভূত মেরেছিলেন বাসুদেব আচারিয়া, তৃণমূল মেরেছিল চড়

প্রসেনজিৎ চৌধুরী: একটু দূরে ঝাড়খণ্ড সীমানা। আর আমি দাঁড়িয়েছিলাম পশ্চিমবঙ্গের দিকে। সামনে একটা কালভার্ট। রেল লাইনের পাশ দিয়ে পায়ে চলা পথ। ঝোপঝাড়, ছোট্ট একটা জলা।…

প্রসেনজিৎ চৌধুরী: একটু দূরে ঝাড়খণ্ড সীমানা। আর আমি দাঁড়িয়েছিলাম পশ্চিমবঙ্গের দিকে। সামনে একটা কালভার্ট। রেল লাইনের পাশ দিয়ে পায়ে চলা পথ। ঝোপঝাড়, ছোট্ট একটা জলা। কালভার্ট থেকে একটু দূরে তারের খুঁটি। তখনও বেলা শেষ হয়নি। গোধূলি আলো ছড়িয়ে আছে। ‘আর যাবেন না,ওখানেই তো ওই মেয়েটা থাকে!’ চমকে গেলাম। পাশে থাকা ছেলেটা বলছিল ‘রাত হলেই ও বেরিয়ে আসে। লাইনের উপর হাঁটে। কোনো ট্রেন ওকে পেরোতে পারে না। কত ড্রাইভার দেখেছে। স্টেশনে বসে থাকে মেয়েটা। খিলখিল করে হাসে।’ এতক্ষন ছেলেটার বয়ানে যা লিখলাম সেটাই বেগুনকোদর স্টেশন নিয়ে চালু কথা। পুরুলিয়ার এই প্রান্তিক অখ্যাত স্টেশনটি ভূতের কাহিনীর দৌলতে বিখ্যাত ছিল। সেই বদনামটি ঘুঁচিয়েছিলেন বাসুদেব আচারিয়া। প্রবীণ CPIM নেতা রবিবার বার্ধক্যজনিত কারণে প্রয়াত হয়েছেন। তিনি ছিলেন দেশের রেল ব্যবস্থা ও পরিষেবা আধুনিকীকরণের অন্যতম সংসদীয় ব্যক্তিত্ব।

বাঁকুড়ার বাম সাংসদ বাসুদেব আচারিয়া কুসংস্কার বিরোধী যুক্তিবাদ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের অন্যতম ব্যক্তিত্ব।তিনি না থাকলে বেগুনকোদর স্টেশন ঘিরে ভূতের যে গল্প চালু করা হয়েছিল সেটা জীবিত থাকত। গল্পের ভূতকে ট্রেন চাকায় ফেলে মেরেছিলেন বাসুদেব আচারিয়া। আশ্চর্য কাণ্ড, বেগুনকোদরের ভূত কিন্তু আর আসেনি। আসবেও না কোনোদিনই।

যাইহোক ফিরি সেদিনের ঘটনায়। কুড়ি বছর আগের কথা। বেগুনকোদর স্টেশনের ভূত দেখতে গিয়েছিলাম। ফা়ঁকা স্টেশন। ভাঙা জানালা। নিঝুম। একেবারে খাঁটি বলিউডি ভূতের ঠিকানা। বেলা গড়িয়ে একটা ছেলেকে দেখে ভাবলাম এটাই ভূত! মানুষের রূপ নিয়ে আমার ঘাড়ে কামড়াবে। তো সে ছেলে আমাকে দেখেই বলে রাতে থাকবেন না। আপনার মতো দুজন আগে এসেছিল। ভূত দেখেছিল। কথা বলতে বলতে কালভার্টের দিকে যেতেই ও বলেছিল ‘ওখান দিয়েই মেয়েটা উঠে আসে!’ ভয়ে ছেলেটা ছুটে চলে যায়। ফাঁকা বেগুনকোদরে একলা বসেছিলাম। মশার কামড়ে গা ফুলিয়ে সকালবেলায় আশেপাশের এলাকার কয়েকজনকে চমকে দিয়ে ফিরেছিলাম।

ইংরাজি, হিন্দি সংবাদপত্রের রোমহর্কক সিরিজ বর্ণনায় বেগুনকোদরের ভূত কিন্তু তারপরেও ছিল! এবার আসরে নামে যুক্তিবাদীরা। তাদের মাধ্যম দিয়ে বেগুনকোদরের বিষয়ে জেনে বাসুদেব আচারিয়া স্টেশনটিকে ভূত গল্প মুক্ত করার কাজে নামেন। দক্ষিণ পূর্ব রেলের বেগুনকোদর চালু হয়েছিল ১৯৬০ সালে। দীর্ঘ সময় ধরে ভূতের গল্প ছড়িয়ে স্টেশনটির টিকিট বিক্রি বন্ধ হয়েছিল। সিপিআইএম সাংসদ ও রেলওয়ে মন্ত্রকের সাথে সংশ্লিষ্ট কমিটিগুলির শীর্ষ পদে থাকার সুবাদে বাসুদেব আচারিয়ার উদ্যোগে ২০০৭ সালে স্টেশনটি পুনরায় চালু হয়। স্টেশনের আধুনিকীকরণ হয়।

রাজ্যে ও কেন্দ্রে তখন ভরা বাম শক্তি। বাঁকুড়া থেকে টানা সাংসদ হতেন বাসুবাবু। থাকতেন পুরুলিয়ার রেল শহর আদ্রায়। সেই বাম শক্তি ২০১১ সালে রাজ্যে ক্ষমতা হারায়। ২০১৪ সালে বাসুদেব আচারিয়াকে হারিয়ে দেন তৃ়নমূলের মুনমুন সেন। এরপর শুধুই বাম বিপর্যয়। বাসুদেব আচারিয়ার মতো নেতা কোণঠাসা হচ্ছিলেন। পরিস্থিতি এমন হলো যে তৃ়নমূলের তরুণ তুর্কী সমর্থক বাসুদেব আচারিয়াকে চড় মারল। তবে চড় খেয়েও প্রবীণ বাম নেতা রাজজনীতি থেকে সরে যাননি। রাস্তায় ছিলেন।