আয়তনে বাংলার দুই-তৃতীয়াংশ, কলকাতার জনসংখ্যার তিনভাগের এক ভাগ, বিশ্বকাপের মঞ্চ কাঁপাচ্ছে এই দেশ

ক্রোয়েশিয়ার (Croatia) আয়তন পশ্চিমবঙ্গের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। তবে জন-সংখ্যা মাত্র ৪০ লক্ষ। কলকাতার জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগ, তা সত্ত্বেও বিশ্বকাপের মঞ্চে দাপট দেখাচ্ছে ইউরোপের এই…

Croatia is giving tough challenges

ক্রোয়েশিয়ার (Croatia) আয়তন পশ্চিমবঙ্গের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। তবে জন-সংখ্যা মাত্র ৪০ লক্ষ। কলকাতার জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগ, তা সত্ত্বেও বিশ্বকাপের মঞ্চে দাপট দেখাচ্ছে ইউরোপের এই ছোট্ট উজ্জ্বল দেশটি।

যুদ্ধবিধ্বস্ত ক্রোয়েশিয়ার কাছে ফুটবলই ছিল ঘুরে দাঁড়ানোর সম্বল। মডরিচ, র‍্যাকিটিচ, মারিও মাঞ্জুকিচের মতো তারকা প্রমাণ করে দিয়েছিলেন মাত্র ২৭ বছর বয়সি একটি দেশ ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার অনেক হেভিওয়েট দলকেই পিছনে ফেলতে পারে। প্রমাণ করে দিয়েছিলেন ফুটবলই হোক কিংবা যুদ্ধের ময়দান— লড়াই করতে জানেন তাঁরা। এমনকি সাবেক ক্রোট তারকা ডেভর সুকার নিজে মুখে জানিয়েছিলেন এ-কথা।

বিশ্বের ‘তরুণতম’ দেশের তালিকায় অন্যতম নাম ক্রোয়েশিয়া। ১৯৯১ সালে স্বাধীন দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করার পরের বছরই ফিফার খাতায় নাম লেখায় ক্রোটরা। বছর দুয়েকের মধ্যেই ফিফা র‍্যাঙ্কিং-এর তালিকায় শেষ থেকে প্রথম পঞ্চাশে উঠে এসেছিল ক্রোয়েশিয়া। জিতে নিয়েছিল ফিফার ‘বেস্ট মুভার’ পুরস্কার। তবে তখনও পর্যন্ত স্থিতিশীল হয়নি সে-দেশের পরিস্থিতি। ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত একটানা চলেছে যুদ্ধ। বয়েছে রক্তস্রোত। তা সত্ত্বেও জন্মলগ্নেই ফুটবল দুনিয়ায় নজরকাড়া পারফর্মেন্স মেলে ধরেছিল এই দেশ। ক্রোটদের সেই সাফল্যের খতিয়ান না হয় দেওয়া যাবে পরে, তার আগে ঝালিয়ে নেওয়া দরকার ক্রোয়েশিয়ার ইতিহাস।

১৯১৮ সাল। সার্বিয়া, স্লোভানিয়া, ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া, মন্টেনেগ্রো এবং মেসিডোনিয়া নিয়েই গড়ে উঠেছিল যুগোশ্লাভিয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুগোশ্লাভিয়ায় থাবা বসায় অক্ষশক্তি। সে-দেশের একাংশে আধিপত্য বিস্তার করেছিল নাৎসি জার্মানি, অন্য অংশটি চলে গিয়েছিল ইতালির দখলে। সেই থেকেই যুদ্ধ শুরু যুগোশ্লাভিয়ায়। ১৯৪২ সাল মার্শাল টিটোর নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল যুগোশ্লাভিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি। পরের বছর স্থাপিত হয় অস্থায়ী সরকারও। একের পর এক এলাকা অক্ষশক্তির থেকে মুক্ত করে মার্শাল টিটোর যোদ্ধারা। সবমিলিয়ে ৭ বার এই অঞ্চলগুলিকে ফের অধিগ্রহণ করতে অভিযান চালিয়েও ব্যর্থ হয়েছিলেন হিটলার।

বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ফুটবলের জগতে অন্যতম নাম হয়ে ওঠে যুগোশ্লাভিয়া। ধারাবাহিকভাবে প্রতিটি বিশ্বকাপেই বিশ্ববাসীকে কোনো-না-কোনো চমক দিয়েছিল তারা। ঘটিয়েছিল অঘটন। তবে ফুটবলকে কেন্দ্র করে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই চালিয়েছিল যে-দেশ, সেই যুগোশ্লাভিয়াই খোদ অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ-দাঙ্গার শিকার হয় নব্বই-এর দশকে। অনেক আঙ্গিকের পাশাপাশি, তার একটা কারণ ছিল ফুটবলও।

হ্যাঁ, শুনতে খানিকটা অবাক লাগলেও সত্যি। আসলে যুগোশ্লাভিয়ায় মূলত চারটি জনজাতির বাস। স্লাভ, ক্রোট, সার্ব এবং বসনিয়ান। সভ্যতা তৈরির আগে থেকে একাধিকবার যুদ্ধ লেগেছে এই জনজাতিগুলির। আশির দশকের শেষেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার খবর চাঞ্চল্য ছড়িয়েছিল যুগোশ্লাভিয়ায়। ক্রমশ উত্তেজনা বাড়তে থাকে স্থানীয়দের মধ্যে। বাড়তে থাকে রাজনৈতিক এবং জাতিগত দ্বন্দ্ব ও বৈষম্য। পরবর্তীতে যা রূপ নেয় বলকান যুদ্ধের।

মজার বিষয় হল, এই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল একটি ফুটবল ম্যাচে। ১৯৯০ সাল সেটা। মাঠে নেমেছিল যুগোশ্লাভিয়ার দুটি দল— ডিনামো জারগেভ এবং রেডস্টার বেলগ্রেড। জারগেভের সমর্থকরা ছিলেন মূলত ক্রোট, অন্যদিকে সার্বরা ছিলেন বেলগ্রেডের সমর্থনে। উত্যক্ত বাক্য-বিনিময় থেকেই পরিস্থিতি রূপ নেয় রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার। ক্রমশ সেই দাঙ্গার আগুন ছড়িয়ে পড়ে গোটা যুগোশ্লাভিয়াজুড়ে। এমনকি এর কয়েকমাস পরে এক ফুটবল ম্যাচেই প্রথম উন্মোচিত হয়েছিল ক্রোয়েশিয়ার বর্তমান পতাকা।

সার্ব ও ক্রোটদের এই গৃহযুদ্ধে কম মানুষ প্রাণ হারাননি। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়েছিল ক্রোয়েশিয়াকেই। এমনকি আজকের ক্রোয়েশিয়া দলের অধিকাংশ খেলোয়াড়ের সঙ্গেই কোনো-না-কোনো ভাবে যোগ রয়েছে যুদ্ধের। খোদ ক্রোয়েশিয়ান অধিনায়ক লুকা মডরিচের ঠাকুর্দাই প্রাণ হারিয়েছিলেন সেই স্বাধীনতা যুদ্ধে।

যাক সে-কথা। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে যুগোশ্লাভিয়ার ছত্রছায়া থেকে বেরিয়ে স্বাধীনভাবে ফুটবল তথা ক্রীড়াজগতে নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করাই ছিল ক্রোয়েশিয়ার অন্যতম লক্ষ্য। অভাব ছিল না তারকারও। ১৯৮৭–তে যুগোশ্লাভিয়াকে যুব বিশ্বকাপ এনে দেওয়া দলের অধিকাংশ খেলোয়াড়ই ছিলেন ক্রোট। তাঁদের নিয়েই শুরু হয় লড়াই। স্বাধীনতার দু’বছরের মধ্যেই তাই ফিফার প্রথম পঞ্চাশে অনায়াসে জায়গা করে নেয় ক্রোয়েশিয়া। ডেভর সুকারের নেতৃত্বে ১৯৯৬-র ইউরো কিংবা ১৯৯৮-এর বিশ্বকাপে নজির গড়ে সদ্যোজাত দেশটি। তৃতীয় স্থান দখল করা তো বটেই, পাশাপাশি ’৯৮-এর বিশ্বকাপে গোল্ডেন বুটও পেয়েছিলেন সুকার। ক্রোয়েশিয়ার এই সাফল্য নজর কেড়েছিল গোটা বিশ্বের। সহমর্মিতা আদায় করে নিয়েছিল বিশ্ববাসীর।

তবে চলতি শতকের শুরু থেকেই একটু একটু করে দুর্নীতি জায়গা করে নিয়েছে ক্রোয়েশিয়ার প্রশাসনিক মহলে। তার ফলাফল ভোগ করতে হয়েছে জাতীয় দলকেও। ’৯৮-এর বিশ্বকাপের পর একটু একটু করে নিজেদের প্রতাপ হারিয়েছে ক্রোয়েশিয়া। একাধিক অভিযোগ উঠেছিল সে-দেশের ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। বছর কয়েক আগে গ্রেপ্তারও হতে হয় কিছু মানুষকে। খোদ মডরিচকেও দাঁড়াতে হয়েছিল কাঠগড়ায়। তবে হাল ছাড়েনি ক্রোটরা। ২০১৮-তে যুদ্ধ করে প্রমাণ করেছিল এই নিন্তান্ত রাজনীতির অনেক ঊর্ধ্বে গিয়েই ফুটবলের ময়দানে আবার জাদু ফোটাল তারা ব্রাজিলকে হারিয়ে আর নেইমারদের কাঁদিয়ে।