কলকাতার প্রথম পিঙ্ক ক্যাব-চালক আত্মবিশ্বাসী মানসীর মুখ দেখতে চায়নি তাঁর বাবা

বিশেষ প্রতিবেদন: প্রথমে অনেকেই দেখে অবাক হয়েছেন। মেয়ে ড্রাইভার (driver)! রাত বিরেতে গাড়ি চালাচ্ছে। ওসব মাথায় নেননি তিনি। ভাবলে পেট চলবে না যে। সে বাবাও…

Manasi Mridha

বিশেষ প্রতিবেদন: প্রথমে অনেকেই দেখে অবাক হয়েছেন। মেয়ে ড্রাইভার (driver)! রাত বিরেতে গাড়ি চালাচ্ছে। ওসব মাথায় নেননি তিনি। ভাবলে পেট চলবে না যে। সে বাবাও মুখ দেখতে চায়নি। জন্ম দেওয়া বাবা মুখ ফেরাল তো অচেনাদের কথা কে ভাবে? দুই ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে হাতে ধরেন স্টিয়ারিং। বসেছেন চালকের সিটে। নারীদের সুরক্ষায় শহরের রাস্তায় ছোটাচ্ছেন পিংক ক্যাব (pink cab)। তিনি মানসী মৃধা দত্ত (Manasi Mridha)।

জন্মের পর থেকেই সঙ্গী হয়েছিল বঞ্চনা। অল্প বয়সেই থেমে গিয়েছিল স্কুলে যাওয়া। নাবা কলিকা অবস্থায় বিয়ে, কিন্তু স্বামীকে হারাতে হল দ্রুত। অমানুষিক লড়াইয়ের এক জীবনে তার পরও জয়ের প্রদীপ জ্বলে উঠেছে তাঁর হাতে।

মানসী মৃধা। রোজগারের জন্যও লড়াই কম করতে হয়নি। লোকের বাড়ি ঠিকে কাজ থেকে কাপড় বিক্রি। কিন্তু সেখানেও বিরূপ হয়েছে ভাগ্য। মানসীই পশ্চিমবঙ্গের প্রথম গোলাপি ট্যাক্সির চালক! বছর খানেক আগে রাজ্য সরকার ঘোষণা করে, শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য চালু হবে ট্যাক্সি। সেই তালিকায় প্রথম নাম ওঠে তাঁর। পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সেই কাজে নেমে পড়েন তিনি।

মানসী মৃধা এক আত্মবিশ্বাসের নাম। চুঁচুড়ায় তার বাড়ি। এখন তার ঠিকানা সন্তোষপুর। তবে এই চুঁচুড়া থেকে সন্তোষপুর পর্যন্ত যাত্রাপথটা কিন্তু মোটেই সহজ ছিল না তার জন্য। বহু প্রতিবন্ধকতায় ভরা সেই পথ পেরিয়ে মানসী আজ গড়ে তুলেছে নিজের অস্তিত্ব।

তার বাবার কাছে মেয়ে জন্মানো ছিল পাপ। তবু মানসীর জন্ম হল। মেয়ে হয়ে জন্মানোর অপরাধে এক সময়ে হাসপাতালে যার মুখও দেখতে আসেনি বাবা। আর তার জন্মের বছর তিনেক পর জন্ম নিল তার বোন। তার বাবা মুখ ফিরিয়ে নিলেন। আদর, ভালবাসা, নিরাপত্তা, স্নেহ এসব তো দূর, দুই মেয়েকে সামান্য খেতে-পরতে দিতেও নারাজ ছিল তার বাবা। ছোট বোনের আবার জন্মের তেরো দিন পর ধরা পড়ল থ্যালাসেমিয়া। তার চিকিৎসা, সুস্থ রাখা, দুই মেয়ের মুখে খাবার জোটানো সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিল তাদের মা। লোকের বাড়ি রান্নার কাজ করে যে ভাতটুকু দুই মেয়ের জন্য তার মা নিয়ে আসতেন, সেটাও খেয়ে নিত তাদের বাবা।

Manasi Mridha

অথচ, তার বাবা কিন্তু ছিল সরকারী চাকুরে। দুই বোন শুধু তাকিয়ে থাকত দুটো ভাতের আশায়; অভুক্ত পেটে। মা স্কুলে ভর্তি করলেন মানসীকে। কিন্তু পড়ার খরচ কে জোটাবে? বাবা স্কুল ছাড়িয়ে দিলেন ঘরে বসিয়ে। তখন দাদু এগিয়ে এলেন। দাদু অর্থাৎ মায়ের বাবা। আবার মানসীকে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করলেন স্কুলে। সামান্য কিছু অর্থ সাহায্যও করলেন। মানসীর মাও মানসীর দাদু-ঠাকুমার সাথে বলতে গেলে ঝগড়া করেই কিছু টাকা পয়সা জোগাড় করলেন। উপায়ই বা কি? বাবা যে বিমুখ। এমন ভাবেই চলতে লাগল দিন। খাওয়ার ঠিক নেই; পরনের জামাকাপড়েরও বেহাল অবস্থা; শুধু আছে আত্মসম্মান। কারুর কাছে হাত পাতবে না মানসী। যদি কেউ নিজে থেকে কিছু দেয়, তবে নেয়। নচেত নয়।

দিনে দিনে পরিস্থিতি প্রতিকূল হয়ে ওঠে। ক্লাস নাইনে উঠল যখন মানসী, তার বাবা তার স্কুল যাওয়া চিরতরে বন্ধ করে দিল। বাড়িতে টেকা দায় হয়ে ওঠে। তখন মানসীর মা দুই মেয়ের হাত ধরে গিয়ে দাঁড়ালেন বাপের বাড়ির দরজায়। মামারা অবশ্য ফেরালেন না। আশ্রয় দিলেন তাদের। আর এরই মধ্যে এল মানসীর বিয়ের সম্বন্ধ আসে। চেনাজানার সূত্রে একটি পরিবার তাদের ছেলের বৌ করে নিয়ে যেতে চাইল তাকে। দাবিদাওয়া কিছু নেই তাদের। যদিও মানসীর বাবা বিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব এমনিতেও নিতেন না৷

এখন তো একেবারেই হাত তুলে নিলেন। নিরুপায় মা-ও সেধে আসা হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলতে পারলেন না। মেয়ে তো ঘরেই বসে আছে। পড়াশোনাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। শ্বশুরবাড়ি গেলে আর কিছু না হোক পেট ভরে ভাত তো জুটবে। অগত্যা প্রায় এককাপড়েই শ্বশুরবাড়ি পথ ধরে মানসী। তারাই অনুষ্ঠান করে ঘরে বরণ করে তাঁকে। চুঁচুড়া থেকে তখন মানসীর নিবাস হল বারাসাত। মানসী তখন মাত্র ষোল।

শ্বশুরবাড়িতে এসে খাওয়া-পরার অভাব ঘুচল। তবে, ছোট মেয়ে, নিতান্ত অভাবের সংসারে মানুষ। বিয়ের কিছু বছর যেতে না যেতেই কোলে দুধের শিশু নিয়ে বিধবা হলেন মানসী। শ্বশুরবাড়ি আর রাখতে চাইল না। অজুহাত, বাড়িতে অবিবাহিত দেওর আছে তাই কম বয়সী বিধবা মেয়েকে বাড়িতে রাখা নিরাপদ নয়। ছেলে কোলে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে মানসী এসে ওঠেন মামারবাড়িতে মায়ের কাছে।

সেখানেও কেউ প্রসন্ন হলেন না। মামীরা ঠেলে পাঠিয়ে দিলেন বাবার কাছে। কিন্তু বাবা বাড়িতে ঢুকতে দিলে তো! মেয়েদের শ্বশুরবাড়িতেই থাকা উচিত, সে যাই ঘটে যাক! অতএব, এবাড়িতে মানসীর স্থান নেই। এগিয়ে আসেন পাড়ার কিছু বয়স্ক মানুষ। তারাই তার বাবার সাথে প্রায় তর্কাতর্কি করে মানসীর বাবাকে রাজি করালেন মেয়েকে বাড়িতে ঠাঁই দিতে। ঠাঁই তো মিলল, কিন্তু মুখের খাবার জুটবে কি করে? বাচ্চাটার দুধের ব্যবস্থা কি করে হবে! অগত্যা মানসী কাজ নিলেন পাড়াতেই এক বয়স্ক মানুষের বাড়ি। স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই বয়স হয়েছে। অতএব, তাদের সব কাজ করে দিতেন মানসী। রান্না করা, বাসন মাজা, কাপড় কাচা সব। বিনিময়ে মিলত একবেলার খাবার।

এভাবে চলল কিছুদিন। কিন্তু ছেলেকে বড় করতে গেলে দরকার পয়সার। প্রথমে কিছুদিন বিধবা ভাতা, স্বামীর জমানো জীবনবিমার কিছু টাকা যা পেয়েছিলেন, তাই ভাঙিয়ে চলছিল। কিন্তু তাতে আর কদিন চলে? মাঝে কাপড় সেলাই, বিক্রি সবরকম চেষ্টা করেন। মাঝে ব্যাঙ্কে ডকুমেন্ট চেকিং এর কাজ। এমন সময়ে জীবনের মোড় ঘুরল মানসীর। সোনারপুরে একটি চার্চে মাঝে মাঝে যেতেন মানসী। যদি আরো ভাল কোন কাজের খোঁজ থাকে! সেইখানেই এক মহিলা খোঁজ দিলেন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার। আজাদ ফাউন্ডেশন। তারা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা মেয়েদের ড্রাইভিং-এর ট্রেনিং দেয় এবং পেশাদার ড্রাইভার হিসেবে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের শেষে তারা সেইসব মেয়েদের তুলে দেয়, তাদের কলকাতা উইং-এর স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার সংস্থা ‘সখা’-র হাতে। সখা তাদের বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থাতে চাকরির সুযোগ দেয়। রাজি হয়ে গেলেন মানসী।

ব্যাঙ্কের চাকরি ছেড়ে দিলেন। ছেলেকে রাখলেন স্কুলের আশ্রমে। আট মাসের ট্রেনিং নেন। তখন ২০১৬ সাল। আজাদ ফাউন্ডেশন গাড়ি চালানো শেখানোর পাশাপাশি ম্যাপ রিডিং, ফার্ষ্ট এইড, আত্মরক্ষা, ইংরেজি বলার মতো বিষয়েও প্রশিক্ষণ দেয়, যাতে তাঁরা পেশাদার ড্রাইভার হিসেবে আত্মবিশ্বাস ও দক্ষতার সঙ্গে কলকাতার রাস্তায় গাড়ি চালাতে পারেন। সব শিখলেন মানসী। যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে প্রশিক্ষণ শেষ করলেন। এরপর তিন বছর গাড়ি চালালেন বিভিন্ন আবাসনে; বিভিন্ন মানুষের বাড়ি।

সোনারপুর ছেড়ে উঠে এলেন সন্তোষপুরে আর একটু বড় ঘরে। যদিও ভাড়ার বাড়ি! তবু নিজের উপার্জনের ফসল তো! এইসময়ে তাঁর ছেলেও তাঁকে সহযোগীতা করেছে সবরকমভাবে। বন্ধুদের থেকে পুরোনো বই নিয়ে পড়েছে, পুরোনো জামা পরেই দিন কাটিয়েছে। মা’কে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে যে! তবে তাদের জীবনে আসবে একটু স্বচ্ছলতা। মা-ছেলের এত কষ্ট বৃথা যায়নি। আস্তে আস্তে সংসারের অর্থকষ্ট হ্রাস পাচ্ছে। রোজগার বাড়ছে মানসীর। তবে নিজের একটা গাড়ির বড্ড স্বপ্ন মানসীর। সে স্বপ্নও পূর্ণ হল তাঁর।

২০১৯ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার পরিকল্পনা করলেন শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য ক্যাব প্রচলন করা হবে; যেটা চালাবেও মেয়েরাই। পিঙ্ক ক্যাব। সখা ফাউন্ডেশন সরকারকে প্রস্তাব দিল এমন একটা পদক্ষেপে একসাথে মিলে কাজ করার জন্য। প্রস্তাব গৃহীত হল। সঙ্গে সঙ্গে অ্যাপ্লিকেশন জমা দিলেন মানসী। মোট দেড়শোটি অ্যাপ্লিকেশন জমা পড়েছিল। তার মধ্যে প্রথম যে নামটি মনোনীত হল, সেটি ছিল ‘মানসী মৃধা’। আমাদের মানসী, যার কথা এতক্ষণ পড়লেন। এই রাজ্যের প্রথম ‘পিঙ্ক ক্যাব ওনার’। সরকার থেকে মানসীকে নিজের গাড়ি দেওয়া হল। স্বপ্ন পূরণ হয় মানসীর।