এইভাবেই খুন হয়েছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন এফ কেনেডি

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এক স্মরণীয় দিন ২২ নভেম্বর। ১৯৬৩ সালের ২২শে নভেম্বর খুন হন সেদেশের রাষ্ট্রপ্রধান জন এফ কেনেডি (John f kenedy)। যদিও আততায়ীর গুলিতে…

John f kenedy the president of USA murdered by this way

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এক স্মরণীয় দিন ২২ নভেম্বর। ১৯৬৩ সালের ২২শে নভেম্বর খুন হন সেদেশের রাষ্ট্রপ্রধান জন এফ কেনেডি (John f kenedy)। যদিও আততায়ীর গুলিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিহত হবার ঘটনা নতুন নয়, তবে কেনেডি ছিলেন সবচেয়ে কমবয়সী এবং প্রথম রোমান ক্যাথলিক। তবে তাঁর মৃত্যু রেখে গেছে এক ঝাঁক প্রশ্ন, যার উত্তর পাওয়া যায়নি ৬০ বছর পরেও। কি হয়েছিল সেদিন?

টেক্সাসে আসার কিছুদিন আগেই পার্লামেন্টে নাগরিক অধিকার রক্ষা বিল আনার কথা ঘোষণা করেছিলেন ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট৷ প্রবল বিরোধিতা এসেছিল রিপাবলিকানদের পক্ষ থেকে৷ আর ঘোষণার দিনই (১২ই জুন) আততায়ীর গুলিতে মিসিসিপিতে খুন হন কৃষ্ণাঙ্গ নেতা মেডগার এভার্স৷ এমন অবস্থায় রোড শো করতে রিপাবলিকান দুর্গ টেক্সাসে কেনেডি ? তীব্র আপত্তি জানিয়েছিলেন FBI কর্তা এডগার হুভার।

ডালাস বিমানবন্দরে নামলো এয়ারফোর্স ওয়ান।
শুরুতেই গণ্ডগোল৷ ঠিক হয়েছিল ১৪ গাড়ির কনভয়ে প্রেসিডেন্ট থাকবেন ঠিক মাঝামাঝি , অর্থাৎ ৭ নম্বরের ছাদ খোলা লিমুজিনে৷ কিন্ত্ত না জানি কার ভুলে দেখা গেল কনভয়ের শুরুতেই কেনেডির গাড়ি৷ সংবাদ মাধ্যমের জন্য নির্দিষ্ট গাড়িটি রয়েছে সব শেষে৷ স্টিয়ারিং হুইলে ৩৫ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সিক্রেট সার্ভিস এজেন্ট বিল গ্রিয়ার৷ মাঝের সারির ডান দিকে গভর্নর জন কনোলি , বাঁ দিকে তাঁর স্ত্রী৷ একেবারে পিছনের সারিতে গভর্নরের ঠিক পিছনে কেনেডি ও তাঁর বাঁ দিকে স্ত্রী জ্যাকেলিনকে নিয়ে যাত্রা শুরু করল কনভয়৷ পথের দু’পাশে অন্তত আড়াই লক্ষ মানুষের জমায়েত৷ গাড়ি ঢুকবে এলম স্ট্রিটে৷ তার আগে ডিলি প্লাজা৷ ঘড়িতে সময় দুপুর ১২:৩০। পিছন ফিরে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে রসিকতা করছিলেন কনেলি , ‘আর কিন্ত্ত বলতে পারবেন না ডালাস আপনাকে চায় না৷ দেখেছেন কত ভিড় ?’ হেসে পাল্টা জবাব দিতে যাচ্ছিলেন কেনেডিও৷

ঠিক তখনই মোড়ের বুক ডিপোজিটারি স্টোরের ছ’তলার জানলা থেকে শোনা গেল তীক্ষ্ণ আওয়াজটা৷ রাইফেলের শব্দ৷ জবাব গলাতেই আটকে গেল প্রেসিডেন্টের৷ ম্যানলিকার -কারসানো রাইফেলের ব্যারেল থেকে বেরিয়ে আসা বুলেট সেকেন্ডে ৫১৮ মিটার গতিতে আঘাত করল প্রেসিডেন্টের পিঠে৷ কণ্ঠনালী ছিন্নভিন্ন করে বেরিয়ে গেল৷ দম আটকে চোখ ঠেলে বেরিয়ে এল কেনেডির৷ সামনের সারিতে বসা কনোলিও হঠাত্ হেলে পড়লেন সামনে৷ প্রেসিডেন্টকে ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা গুলি সেকেন্ডে ৪৫৭ মিটার বেগে আঘাত করল গভর্নরের পিঠে৷ পাঁজরা , ডান দিকের ফুসফুস ফুটো করে বুক দিয়ে বেরিয়ে ভেঙে দিল গভর্নরের কব্জি৷

গুলির শব্দ পেতেই সচকিত হয়ে উঠেছিলেন নিরাপত্তারক্ষীরা৷ পিছনের গাড়িতে থাকা ক্লিন্ট হিল সবার আগে দেখতে পেয়েছিলেন কেনেডির অবস্থা৷ অলিম্পিকে ১০০ মিটার দৌড় শুরু করার ভঙ্গিতে তিনি তেড়ে গেলেন লিমুজিন লক্ষ করে৷ এর মধ্যেই ফের গুলির শব্দ৷ এ বারেরটা লক্ষ্যভ্রষ্ট৷ হিল যখন লাফিয়ে উঠছেন জ্যাকেলিন ও জন কেনেডিকে নিজের শরীর দিয়ে আড়াল করতে তখনই এল শেষ গুলিটা৷ কনভয়ের একটু বাঁ দিকে মোটর সাইকেলে বসে থাকা সিক্রেট সার্ভিস এজেন্ট হারগিস দেখলেন যাঁকে রক্ষা করতে এত আয়োজন , তাঁর মাথাটা হঠাত্ রক্ত আর মস্তিষ্কের মেঘ হয়ে গেল৷ পর মুহূর্তেই হারগিস স্নান করে গেলেন প্রেসিডেন্টের রক্ত আর মাথার ঘিলুতে৷ চারপাশে তখন ত্রাহি ত্রাহি রব, এলাকা ছেড়ে পালানোর হিড়িক পড়ে গেলো।

ছ’মিনিটের মধ্যে প্রেসিডেন্টকে নিয়ে গাড়ি পৌঁছে গিয়েছিল পার্কল্যান্ড মেমোরিয়াল হাসপাতালে৷ প্রধান চিকিত্সক পল পিটার্স না আসা পর্যন্ত কেউ কোনও মন্তব্য করেননি৷ দুপুর ১টা ৩৮ -এ টিভির পর্দায় ব্রেকিং নিউজ দেখলো গোটা আমেরিকা… আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছেন প্রেসিডেন্ট জন কেনেডি৷ ৷‌

কেটে গেছে ষাটটি বছর৷ মাঝের সময়ে প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডিকে খুন করা নিয়ে লেখা হয়েছে অন্তত ৪০ হাজার বই৷ মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে বসানো হয়েছে ছ’টা কমিশন৷ এলম স্ট্রিট ও হিউস্টন স্ট্রিটের সংযোগস্থলে বুক ডিপোজিটরি স্টোরের উল্টো দিকে একই পরিস্থিতি তৈরি করে চলেছে পরীক্ষা৷ কিন্ত্ত না , উত্তর মেলেনি সেই প্রশ্নের৷ প্রেসিডেন্ট জন কেনেডির হত্যাকাণ্ড কি একটা বিচ্ছিন্ন খুনের ঘটনা , না কি এর পিছনে রয়েছে গভীর ষড়যন্ত্র ? যদি ষড়যন্ত্র হয় , তা হলে কারা থাকতে পারেন এর নেপথ্যে ? জবাবে চক্রান্ত তত্ত্বের প্রবক্তারা আঙুল তোলেন একাধিক দিকে৷

কখনও সোভিয়েত গুপ্তচর সংস্থা কেজিবি , কখনও কিউবার শাসক ফিদেল কাস্ত্রো , কখনও সিসিলিয়ান মাফিয়া , কখনও বর্ণবিদ্বেষী রিপাবলিকান শিবির , এমনকি সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ নেই খোদ মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা CIA -ও৷

যাঁরা ষড়যন্ত্র তত্ত্বের সমর্থক এবং যাঁরা এই তত্ত্বের বিরোধী , উভয় পক্ষই তাঁদের বক্তব্যের সমর্থনে পেশ করেন ডালাসের এক পোশাক প্রস্ত্ততকারীর তোলা ছবিকে৷ আব্রাহাম জাপ্রুডার৷ ১৯৬৩ -র ২২ নভেম্বর বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ ডিলি প্লাজার ঠিক আগে ৮ মিলিমিটার ফিল্মের বেল অ্যান্ড হাওয়েল ক্যামেরার পিডি ৪১৪ মডেলের একটি মুভি ক্যামেরা নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন ৫৮ বছরের জাপ্রুডার৷ কেনেডির গোঁড়া সমর্থক আব্রাহাম এসেছিলেন তাঁর ছবি তুলতে৷

বুক ডিপোজিটরির সামনে দিয়ে প্রেসিডেন্টের কনভয় এলম স্ট্রিটের দিকে ঘুরতেই মাথার ওপর হাত তুলে ভিড় এড়িয়ে ছবি তোলা শুরু করেন আব্রাহাম৷ পরের ২৬.৬ সেকেন্ডে যে ৪৮৬টি ফ্রেম উঠেছিল তাঁর ক্যামেরায় , তার জোরেই কেনেডি হত্যা মামলার সঙ্গে জড়িয়ে যায় তাঁর নাম৷ প্রতিটি ফ্রেমে উঠে গিয়েছিল হত্যার পুঙ্খানুপুঙ্খ৷ এমন কী ছিল ওই ছবিগুলিতে ? প্রথমত এমন এক ব্যক্তি যাঁর হাতে ছিল কালো ছাতা৷ প্রেসিডেন্টের লিমুজিন বাঁক নেওয়ার ঠিক আগে তিনি ছাতা খুলেছিলেন৷ কেন ? নভেম্বরের ঠান্ডা দুপুরে ছাতা খোলার কী দরকার ছিল ? তবে কি ছাতা খুলে কাউকে কোনও ইঙ্গিত করা হয়েছিল ?

প্রেসিডেন্টের লিমুজিন একটা করে বাঁক নিচ্ছে আর ছাতা খুলে যেন সেই খবর দেওয়া হচ্ছে দূরের কাউকে৷ পরবর্তীকালে মার্কিন পুলিশ খুঁজে বের করেছিল সেই ‘রহস্যময় ’ ছাতাধারীকে৷ জানা যায় তাঁর নাম লুইস উইট৷ ছাতা খুলে তিনি নাকি রাজনৈতিক প্রতিবাদ করছিলেন৷ তাঁর বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি৷ সন্দেহের কারণ এই একটাই নয় , ছবিতে দেখা গিয়েছে , মাথার পিছন দিকে গুলি লাগার পর কেনেডির মাথা ঝুঁকে গিয়েছে পিছন দিকে৷ কিন্ত্ত হওয়ার কথা এর উল্টোটাই৷ তা হলে কি আসলে গুলি এসেছিল সামনের দিকের ডিলি প্লাজা থেকে ?

একা অসওয়াল্ড নন , আরও কাউকে রাখা হয়েছিল প্রেসিডেন্টকে খতম করার জন্য ? সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায়নি৷ একাধিক ছবিতে দেখা গিয়েছে ডিলি প্লাজায় দাঁড়িয়ে রয়েছে দীর্ঘকায় এক ব্যক্তি৷ বহু দূর থেকে তোলা ছবিতে মুখ স্পষ্ট নয়৷ হাতে ধরা জিনিসটা রাইফেল কি না তা-ও বোঝা যায় না৷ কিন্ত্ত আকারে মনে হয় রাইফেল হতেও পারে৷ হত্যার যে রাইফেল ব্যবহার করা হয়েছিল , সেই ম্যানলিকার -কারসানো আগ্নেয়াস্ত্র হিসেবে আদৌ উঁচুদরেরও নয়৷ রাইফেলের পক্ষে ৭৫ গজ তেমন কোনও দূরত্ব না হলেও মাত্র ছয় সেকেন্ডের ব্যবধানে তিন বার গুলি ছোড়া এবং দু’বার নিশানায় আঘাত করা কতটা সম্ভব তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে৷ হত্যাকাণ্ডের পর অসওয়াল্ডকে গ্রেন্তার করে পুলিশ৷ কিন্ত্ত তাঁকে আদালতে পেশ করতে নিয়ে যাওয়ার সময় থানার মধ্যেই সকলের সামনে তাঁকে গুলি করে মারেন জ্যাক রুবি৷ অপরাধী ‘হাই প্রোফাইল ’৷ একদিন আগেই খুন করেছেন স্বয়ং প্রেসিডেন্টকে৷ বিনা তল্লাশিতে তাঁর একেবারে সামনে গেলেন কী করে সশস্ত্র রুবি ?

সংবাদমাধ্যমের বিপুল ভিড় ঠেলে সামনে এসে রিভলভার বের করে গুলি করা পর্যন্ত একজন পুলিশকর্মীও কেন আটকানোর চেষ্টা করলেন না রুবিকে ? মেলেনি তারও জবাব৷ আসলে প্রেসিডেন্টের ডালাস সফর শুরুর আগে থেকেই গণ্ডগোলের শুরু৷ দুনিয়ার কোথাও খবরের কাগজে ফাঁস হয় না প্রেসিডেন্টের কনভয়ের রুট৷ কিন্ত্ত এ ক্ষেত্রে হয়েছিল৷ পৃথিবীর কোনও দেশে কনভয়ের শুরুতে রাখা হয় না রাষ্ট্রপ্রধানকে৷ এখানে তেমনটাই হয়েছিল৷ বর্ণ সংস্কারের আইন ঘোষণার পরই যখন খুন হন মেডগার এভার্স, তখনও সতর্ক হননি গোয়েন্দারা৷ গাড়িতে বাবলটপ না নেওয়া নিয়ে কেনেডির জেদের কাছে সত্যিই কি হার মেনেছিলেন এফবিআই কর্তা ?একসঙ্গে এতগুলো ভ্রান্তি কি নিছক কাকতালীয় ?

এতদিন পার করেও এর জবাব মেলেনি৷ প্রেসিডেন্ট হত্যার তিন বছরের মধ্যেই ১৮ জন সাক্ষীর রহস্যমৃত্যুরও কোনও সদুত্তর দিতে পারেনি মার্কিন প্রশাসন৷ নিহত ১৮ জনের মধ্যে ছ’জন খুন হন বন্দুকের গুলিতে , তিন জন মারা পড়েন গাড়ি দুর্ঘটনায় , আত্মহত্যা করেন দু’জন , একজনকে পাওয়া যায় গলা কাটা অবস্থায়৷ হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে হঠাত্ মারা যান তিন জন৷ ক্যারাটের মোক্ষম মারে ভেঙে দেওয়া হয় একজনের গলা৷ মাত্র দু’জন নাকি ‘স্বাভাবিক ভাবে ’ মারা গিয়েছিলেন৷ বিশেষজ্ঞরা বলেন , একই মামলার সঙ্গে যুক্ত ১৮ জন সাক্ষীর তিন বছরের মধ্যে মারা পড়ার সম্ভাবনা গাণিতিক ভাবে নেই বললেই চলে৷ তাই সেই অভিশন্ত দিনের পর ৬০ বছর পরেও জন ফিটজেরাল্ড কেনেডির হত্যা আজও এক রহস্য!