Giordano Bruno: সত্যি বলতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন এই ব্যক্তি

ণ বিজ্ঞানী যাঁকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল তাঁর নাম জিওর্দানো ব্রুনো (Giordano Bruno)। ব্রুনোর জন্ম ১৫৪৮ সালে ইতালির নেপলস(সেই সময়ের কিংডম অব নেপলস) এর ‘নোলা’তে। তাঁর বাবার নাম ছিল জিওভান্নি ব্রুনো, আর মা ছিলেন ফ্রলিসা সভোলিনো।

Giordano Bruno, Offbeat Story

সত্যের মৃত্যু হয় না। সত্য সত্যই। সত্যটাকে যদি একজন স্বীকার করে আর লাখ লাখ মানুষ যদি তা অস্বীকার করে তবুও সত্যের সত্যটা পাল্টায় না। ১৬০০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি দিনটা সত্যের জন্য বলিদান বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক অন্যতম নিষ্ঠুর দিন হিসাবে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

আমাদের এই পৃথিবীতে প্রতিদিন কতো কিছু নিত্য-নতুন উদ্ভাবন আর আবিষ্কার হয়ে চলেছে। আর এই আবিষ্কারের পেছনে রয়েছে অসংখ্য নাম-না-জানা কিংবা চেনা-জানা বিজ্ঞানীদের অমূল্য অবদান এবং আত্মত্যাগ। পাশাপাশি আবার বৈজ্ঞানিক সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ধর্মগুরু, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের কর্ণধারদের রোষানলে পড়ে জীবন হারাতে হয়েছে অনেক বিজ্ঞানীর। সেরকমই এক নিবেদিতপ্রাণ বিজ্ঞানী যাঁকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল তাঁর নাম জিওর্দানো ব্রুনো (Giordano Bruno)। ব্রুনোর জন্ম ১৫৪৮ সালে ইতালির নেপলস(সেই সময়ের কিংডম অব নেপলস) এর ‘নোলা’তে। তাঁর বাবার নাম ছিল জিওভান্নি ব্রুনো, আর মা ছিলেন ফ্রলিসা সভোলিনো।

   

রোম। রাজপথ, অলিগলি লোকে লোকারণ্য। পিঁপড়ে গলার যায়গা নেই। প্রতিটা বাড়ির চালার উপরে, প্রাচীরে, গাছে — যে যেখান থেকে পারছে উঁকি দিচ্ছে। সকলের চোখে অন্ধকারের হাসি। অবাক দৃষ্টিতে, আগ্রহ নিয়ে সকলেই হাজির মঞ্চের চারিদিকে। সত্যকে হত্যা করা হবে আর কিছুক্ষণ পর। আসামী জিওর্দানো ব্রুনো। ব্রুনোর অপরাধ তিনি ধর্ম ও বাইবেলের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। চিরাচরিত বিশ্বাসকে সত্যের ফলা দিয়ে আঘাত করেছেন। তাই তাঁর মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয় জনসম্মুখে। ব্রুনো ছিলেন একাধারে দার্শনিক, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী। ১৬০০ সালের ২০ জানুয়ারি পোপ অষ্টম ক্লেমেন্ট ব্রুনোকে একজন ধর্মদ্রোহী বলে রায় দেন ও তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেন। ১৭ ফেব্রুয়ারি তাঁকে রোমের কেন্দ্রীয় বাজার Campo de’ Fiori-এ নিয়ে যাওয়া হয়।

সেখানে তাঁকে সবার সামনে খুঁটির সাথে বেঁধে পুড়িয়ে মারা হয়। মিথ্যাকে বাঁচিয়ে রাখতে, ধর্ম ব্যবসাকে বাঁচিয়ে রাখতে, ধর্মালয়কে অক্ষত রাখতে ব্রুনোকে পোড়ানো হলো আজকের দিনে। আগুনে পুড়িয়ে হত্যা! ব্রুনোর হাত পা লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়েছিলো। কারণ, তৎকালীন ধর্ম দ্বারা পরিচালিত বিচারকরাও ভয় পেয়েছিলো। তাই বেঁধে দেওয়া হয়েছিলো তাঁর জিহবা। যদিও মৃত্যু কার্যকর করার আগে ধর্মধারী বিচারক ও চার্চ প্রধান তাঁকে সুযোগ দিয়েছিলো বাঁচবার, যাতে ব্রুনো যা বলেছে তা সম্পূর্ণ ভুল তা প্রকাশ্যে স্বীকার করতে হবে তবেই তাঁর মৃত্যুদন্ড থেকে তাঁকে রেহাই দেওয়া হবে – এমনই শর্তে। না, ব্রুনো তা করেননি। সত্যকে তিনি মাটিতে মিশিয়ে দেননি। ব্রুনো মাথা নত করে বাঁচতে চাননি। তাঁর শরীরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ব্রুনো জ্বলতে থাকলো। না, ব্রুনো জ্বলে শেষ হয়ে যায়নি। শেষ হয়েছে মিথ্যাটা, ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস। ব্রুনোর জ্বলন্ত শরীর থেকে সত্যের আলো চারিদিকে ছড়িয়ে গেছে। আজও তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের গতির সাথে সাথে তিনি আবর্তিত হয়ে চলেছেন।

আপনারা একটু ভাবুনতো, কী এমন অপরাধ করেছিলেন ব্রুনো! তিনি বলেছিলেন, “পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরছে। পৃথিবী সৌরজগতের তুচ্ছ গ্রহ ছাড়া এর আলাদা কোনো গুরুত্ব নেই। পৃথিবী ও বিশ্বজগৎ চিরস্থায়ী নয়, একদিন এসব ধ্বংস হয়ে যাবে।” এই সত্যটাই তিনি বলেছিলেন।

আর আজ তাকে নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। তাঁর মৃত্যু অনেক বড়ো ভুল ছিলো ধর্মবিশ্বাসীরাও পরে তা স্বীকার করেছেন। সেই সময়ে এই সত্যটা মানুষ জানতো না, বোঝারাও চেষ্টা করেনি। আর আজ ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েরাও এই সত্য কথাটা জানে। সেই সময়কার বড়ো বড়ো ধর্মবিশ্বাসী পণ্ডিত আর ধর্মযাজকদেরও এই জ্ঞানটুকু ছিল না। ওরা মনে করতো ‘পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্র, পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে সব গ্রহ-নক্ষত্র।’ বাইবেলে নাকি এমন কথাই লেখা ছিল। তাই ব্রুনো যা বলছেন সবই ধর্মবিরোধী। তাদের আশঙ্কা, ব্রুনোর মতবাদ ছড়িয়ে পড়লে পৃথিবী ধর্মহীন হয়ে পড়বে, সব মানুষ পরিণত হবে শয়তানে। তাই ব্রুনোকে হত্যার এই বিশাল আয়োজন। অথচ ব্রুনোর সেই সত্যির ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে আজকের পৃথিবী।

না, আজও অনেক ধর্ম-বিশ্বাসী, ধর্ম-ব্যবসায়ীরা আছেন, ‘পৃথিবী ঘুরছে, সূর্য স্থির’ – এই সত্যটাকে মানতে পারেন না, বলা ভালো, এখনকার অসংখ্য ধর্মযাজক, পুরোহিত, ধর্ম-পণ্ডিতরা ইচ্ছে করেই মানতে চান না। তখনকার দিনে সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য ব্রুনোকে হত্যা করা হয়েছিল, আর এখনকার দিনেও আমরা আমাদের দেশে দেখতে পাই , ধর্মকে টিকিয়ে রাখার জন্য মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। ধর্ম ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখার জন্য অন্ধবিশ্বাসকে প্রতিনিয়ত প্রচার করা হচ্ছে। সারা দেশজুড়ে কুসংস্কার, ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস, অপবিজ্ঞান, অবিজ্ঞানের যেভাবে ব্যাপকহারে প্রচার ও প্রসার চলছে, তা প্রতিহত করতে এবং সমাজ জীবনে ও মননে যথার্থ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও যুক্তিবোধ এবং আধুনিক বিজ্ঞান চিন্তা-চেতনা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আজ সর্বত্র ব্রুনোর মত সকল দার্শনিক ও বিজ্ঞানী মনীষাদের জীবন সংগ্রাম ব্যাপকভাবে, এমনকি ঘরে ঘরে চর্চার প্রয়োজন। মানুষকে মুর্খ করে রাখার জন্য কাল্পনিক মিথ্যার উপর দাঁড়িয়ে থাকা মায়াবী ধর্ম ঘরে ঘরে প্রচার হচ্ছে, ঘরে ঘরে অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, অপবিজ্ঞানের চর্চা হচ্ছে।

আর আমরা যারা বিজ্ঞানকর্মী, বিজ্ঞানমনষ্কতা নিয়ে চর্চা করি, যুক্তিবাদ নিয়ে আলোচনা করি, আমরা কেন পারছি না ঘরে ঘরে বিজ্ঞানভাবনা প্রচার করতে, কেন পারছি না যুক্তিবাদের প্রচার করতে? আমাদের উচিৎ ঘরে ঘরে গিয়ে সত্যটাকে তুলে ধরা, মানুষকে বুঝানো কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল। আমাদের উচিৎ কাজ হবে ঘরে ঘরে গিয়ে মানুষকে ‘প্রশ্ন’ করতে শেখানো। নতুবা একদিন হয়তো আবার আমাদেরই মধ্যে থাকা কোনো এক ব্রুনোকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হলো।