A P J Abdul Kalam: ব্যর্থতাই সাফল্যের মুখ দেখিয়েছিল ভারতের মিসাইলম্যানকে

বিশেষ প্রতিবেদন: ড: এ পি জে আব্দুল কালামের  (A P J Abdul Kalam) জীবন মানেই কি শুধুমাত্র সাফল্যের খতিয়ান? না, ব্যর্থতা তাঁর জীবনেও এসেছিল। তবে…

Dr apj abdul Kalam also faced failure

বিশেষ প্রতিবেদন: ড: এ পি জে আব্দুল কালামের  (A P J Abdul Kalam) জীবন মানেই কি শুধুমাত্র সাফল্যের খতিয়ান? না, ব্যর্থতা তাঁর জীবনেও এসেছিল। তবে সেই সাময়িক ব্যর্থতা তাঁকে থমকে দিতে পারেনি। ওই ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন নিজের পরবর্তী কর্মজীবনের পথে।

সেই দিনটা ছিল, ১৯৭৯ সালের ১০ই আগস্ট। রকেট উৎক্ষেপণ শুরু করার জন্য সেই দিনটা কিন্তু ‘ইসরো’র পক্ষে মোটেই শুভ ছিল না। কারণ, ‘অন্ধ্রপ্রদেশের’ ‘শ্রীহরিকোটা’ থেকে ‘স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিক্যালের’ (এসএলভি-৩) রকেটের পিঠে চেপে রওনা হওয়ার মিনিট দেড়েকের মধ্যেই বঙ্গোপসাগরে ভেঙে পড়েছিল ‘রোহিনী টেকনোলজি ডেমনস্ট্রেটর উপগ্রহ’। কিন্তু না, তার পরেও ‘মিসাইল ম্যান’ প্রয়াত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডঃ এ পি জে আবদুল কালামকে সে দিন চাকরি থেকে বরখাস্ত করেননি ইসরোর তদানীন্তন চেয়ারম্যান ‘সতীশ ধওয়ন’!

   

তিনি একবারের জন্য বলেননি যে, “কালামকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হল!” কোনও শাস্তি-টাস্তি তো দূরের কথা, বরং, ওই ঘটনা নিয়ে যখন সমালোচনায় সরব হয়েছিল গোটা দেশ, তখন ‘ইসরোর চেয়ারম্যান’ ‘সতীশ ধওয়ন’ সাংবাদিক সম্মেলন করেছিলেন। আর সেই সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি নিজের পাশে বসিয়েছিলেন কালামকেই। সকলের সামনে তাঁর পিঠ চাপড়ে দিয়েছিলেন। বাস্তবে ওই ব্যর্থতা সংক্রান্ত যাঁর ‘সব দোষ’ ছিল, সেই কালামেরই পিঠ চাপড়িয়ে দিয়েছিলেন ধওয়ন!

কিন্তু বাস্তবে কি ঘটেছিল সেদিন? কালামের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ, ‘উইংস অফ ফায়ার’-এ, রয়েছে সেই ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা। সেই অসাফল্যের দিনে ইসরোর ‘রোহিনী’ উপগ্রহ উৎক্ষেপণের মূল দায়িত্বে ছিলেন যে দু’জন, কালাম ছিলেন তাঁদের অন্যতম। বলা ভাল, তিনিই ছিলেন এক নম্বর। অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটার লঞ্চপ্যাডে তখন কাউন্টডাউন শুরু হয়েছিল। সেই সময়েই ইসরোর গ্রাউন্ড কন্ট্রোল রুমে কম্পিউটার জানিয়েছিল, “রকেটে কোনও যান্ত্রিক ত্রুটি (গ্লিচ) রয়েছে। আর সেটা রয়েছে রকেটের দ্বিতীয় পর্যায়ে (সেকেন্ড স্টেজ)। ফলে, উৎক্ষেপণ হলে তা সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।” তবে ঐ স্বয়ংক্রীয় কম্পিউটার শুধুমাত্র এইটুকু জানিয়ে থেমে থাকেনি, কাউন্টডাউনও বন্ধ করে দিয়েছিল। ফলে ইসরোর কন্ট্রোল রুমে শুরু হয়ে গিয়েছিল গুঞ্জন – “কী হবে এ বার? সব কি তাহলে ভেস্তে যাবে?” কেউ কেউ বলতে শুরু করেছিলেন, “কী দরকার এখনই রোহিনীকে উৎক্ষেপণের? কম্পিউটার যখন বলছে তখন উৎক্ষেপণ স্থগিত রাখাই হোক।” কথাটা কালামের কানে পৌঁছেছিল। কিন্তু তিনি সেই সব কথা কানে তোলার পাত্র ছিলেন না।

তাই তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘‘রোহিনীর উৎক্ষেপণ হবে। নির্ধারিত সময়েই। যা-ই বলুক কম্পিউটার, রোহিনীর যাত্রা আটকে থাকবে না।’’ যন্ত্রকে গুরুত্ব না দিয়ে একেবারেই নিজের দায়িত্বে সে দিন যে সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলেন কালাম, সেটা যে ভুল ছিল, তা বোঝা গিয়েছিল উৎক্ষেপণের কয়েক মুহূর্তের মধ্যে বঙ্গোপসাগরে রোহিনী ভেঙে পড়ার পরে। ২০১৯ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর তারিখের ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র পাতায়, মোহনপুরের ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইসার-কলকাতা)’-এর অধ্যাপক ও ‘সৌরপদার্থবিজ্ঞানী’, ‘দিব্যেন্দু নন্দী’ জানিয়েছিলেন, ‘‘এর পর সবাই সমালোচনা শুরু করে দিল কালামের। আপাতদৃষ্টিতে সেটাই স্বাভাবিক ছিল।

কিন্তু চমকপ্রদ ঘটনা ঘটল তার পর। যখন সকলে চমকে গিয়ে দেখলেন, খোদ সতীশ ধওয়ন ওই ঘটনা নিয়ে ডাকা সাংবাদিক সম্মেলনে তাঁর পাশে বসালেন কালামকে। ব্যর্থতার দায় স্বীকারের পর পিঠ চাপড়ে দিলেন কালামের। বললেন, এই টিমটার উপর যথেষ্ট আস্থা রয়েছে। খুব শীঘ্রই আমরা সফল ভাবে রোহিনী উৎক্ষেপণ করতে পারব। সব ভুল-ত্রুটি শুধরে নিতে পারব। কোনও চিন্তা করবেন না আপনারা।’’ ধওয়নের কথাটা সে দিন শুধুই কথার কথা ছিল না। কারণ, তার পর একটা বছরও গড়াতে পারেনি। পুনরায় ‘রোহিনী’ উপগ্রহের সফল উৎক্ষেপণ করেছিল ‘ইসরো’।

ঠিক পরের বছরেই। ১৯৮০ সালের ১৮ই জুলাই তারিখে। দিব্যেন্দু আরও জানিয়েছিলেন, ‘‘মজাটা কি জানেন? সেই সাফল্যের পর ধওয়ন আবার সাংবাদিক সম্মেলন ডাকলেন। কিন্তু সেই সাংবাদিক সম্মেলনে নিজে থাকলেন না। কালামকে দিয়েই করালেন সেই সাংবাদিক সম্মেলন। এটাই ইসরো। এই ভাবেই চলে ইসরো। বিক্রম সারাভাইয়ের হাতে জন্মের পর থেকে ইসরো এই ভাবেই চলে এসেছে। এখনও চলছে। আমার বিশ্বাস, এই ভাবেই চলবে, আগামী দিনেও।’’ ‘চন্দ্রযান-২’-এর ব্যর্থতার কথা মনে আছে? ওই যে, ল্যান্ডার ‘বিক্রম’ চাঁদের পিঠে অবতরণের পরে প্রথমে কোনও সংবাদ (রেডিয়ো সিগন্যাল) পাঠায়নি, চাঁদ থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরের কক্ষপথে আবর্তনরত ‘চন্দ্রযান-২’-এর ‘অরবিটার’কে। এরপরেও কিন্তু ইসরো জানিয়েছিল যে, তাদের ওই অভিযান ৯৫ শতাংশ সফল হয়েছে।

কারণ, ‘অরবিটা’র খুব ভাল কাজ করছে। আর জ্বালানি সাশ্রয়ের ফলে সেটার আয়ুও এক বছর থেকে বেড়ে সাত বছর হয়েছে। এটা কি ইসরো আন্দাজে ঢিল মেরেছিল? দিব্যেন্দু জানিয়েছিল, ‘‘না। এটাও কালামেরই উদ্ভাবিত পদ্ধতি। উৎক্ষেপণের কাউন্টডাউন থেকে শুরু করে সেই অভিযানের শেষ পর্যন্ত কয়েকটি ধাপ থাকে। সেই ধাপগুলি কী ভাবে পেরনো সম্ভব হচ্ছে, সেটা কতটা সফল ভাবে হচ্ছে, তার মুল্যায়ন করেই সেই অভিযানের সাকসেস রেট বা সাফল্যের হার মাপার পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিলেন কালাম।’’ যে কালাম একদিন কম্পিউটারের সিদ্ধান্তকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ইসরোর কাঁধে ‘ব্যর্থতার বোঝা’ চাপিয়েছিলেন, সেই কালামেরই পদ্ধতির ভিত্তিতে ইসরো বলতে পেরেছিল যে ভারতের ওই দ্বিতীয় চন্দ্রাভিযানের সাফল্য কতটা।