Special Report: ১৯৪০ সালে তার বয়স ত্রিশেও পৌঁছায়নি। তার শরীরের চামড়া ছিল উজ্জ্বল, দৃঢ় দৃষ্টি। দেখলে মনেই হবে না যে সে কোনো এক ভয়ানক টিউমার নিয়ে বাস করছে শরীরে। অথচ যে টিউমার তার পাঁচজন সন্তানকে মাতৃহীন করেছে সেই টিউমারই পরিবর্তন করে দিয়েছে মেডিসিনের ভবিষ্যৎ! তার নাম হেনরিয়েটা ল্যাকস (Henrietta Lacks), হেলেন লেন অথবা হেলেন লার্সন নামেও বিশ্বের বিভিন্ন তথ্যকেন্দ্রে সে পরিচিত।
তার এই ছবি শতাধিক ম্যাগাজিন ও বিজ্ঞানের টেক্সট বুক ও ওয়েবসাইট দখল করে আছে। তাকে সাধারণত হেলেন লেন ডাকা হয় কিন্তু আসলে তার কোনো নাম নেই। সায়েন্টিফিক কমিউনিটি তাকে HeLa বলেই জানে, এটি হলো বিশ্বের প্রথম অমর কোষের সাংকেতিক নাম, এ কোষটি শাশ্বত কাল একই স্থানে জীবিত হয়ে থাকবে। তার জরায়ুর কিছু কোষ শরীর থেকে আলাদা করে নেওয়া হয় মৃত্যুর আগে কিন্তু সে বা তার পরিবারের কেউ জানতোনা এ কোষটি এক সময় পৃথিবী অতিক্রম করে মহাকাশ ভ্রমণ করবে!
১৯৫১ সালে হেনরিয়েটা মারাত্মক জরায়ু ক্যান্সার আক্রান্ত হয়। মৃত্যুর পূর্বে একজন সার্জন তার টিউমারের একটি স্যাম্পল সংগ্রহ করেছিলেন, যেটিকে তিনি পেট্রি ডিশের মধ্যে রাখেন। বিজ্ঞানীরা বহুদিন ধরেই মানুষের দেহের কোষকে জীবিত রাখার চেষ্টা করছেন , সেগুলো মরে যায় কিন্তু হেনরিয়েটার সেলগুলো ছিলো সম্পূর্ণ বিপরীত। এরা প্রতি চব্বিশ ঘন্টায় তাদের সম্পূর্ণ জেনারেশনকে রিপ্রডিউস করতে পারে এবং এ প্রক্রিয়া নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতেই থাকে। এগুলোই ল্যাবরেটরিতে জীবিত প্রথম অমর মানব কোষ।
তার এ কোষগুলো আজ জিন গবেষণার একটি অংশ যা ক্যান্সারের কারণ এবং সেগুলোর সাথে যা এটিকে অবদমন করতে পারে। এ সেলগুলো হার্পিস, লিউকেমিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জা, হোমোফিলিয়া এবং পারকিনসন রোগের কারণ এবং লেকটোজ ডাইজেশনের জন্যও ব্যবহার করা হয়। এছাড়া সেক্সচুয়ালি ট্রান্সমিটেট ডিজিজ, এপেন্ডিসাইটিস এবং মস্কুইটো মেটিং নিয়ে স্টাডি করার সময় এ কোষগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে সমস্ত বিশ্বজুড়ে।
হেলেন তার ভাইপোকে বলেছিলেন, তার শরীরে কোনও গিঁট পড়েছে। আসলে একজন সন্তান জন্ম দেওয়ার পর হেনরিয়েটা এবনরমাল ব্লিডিং-এর শিকার হয়েছিলেন। তার ডাক্তার তার জরায়ুতে একটি পিণ্ড খুঁজে পেলেন এবং তার একটি স্যাম্পল ল্যাবে প্রেরণ করলেন। যার ফলাফল ছিল জরায়ু ক্যান্সার। তখন সেই এরিয়ায় আফ্রিকান ও আমেরিকান পেশেন্টদের জন্য একমাত্র মানসম্মত হসপিটাল ছিল জন হপকিন্স, আর সেখানেই ল্যাকসের ট্রিটমেন্ট করা হয়। যখন তার স্বামী ও তার সন্তানরা তার জন্য বাহিরে গাড়িতে অপেক্ষা করতো, তাকে রেডিয়েশন( জরায়ুর চারপাশে একটি রেডিয়াম টিউব ইনসার্ট করে সেই জায়গায় সেলাই করে দেয়া হত) ও এক্স-রে ট্রিটমেন্ট দেয়া হতো। এসব ট্রিটমেন্টের পরও ক্যান্সার বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে ল্যাকসের শরীরে, যা তার মধ্যে অমানবিক যন্ত্রণার জন্ম দেয়। তিনি ১৯৫১ সালের ৪ অক্টোবর ৩১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তার এ রোগ শনাক্ত হওয়ার নয় মাস পর।
রেডিয়েশন ট্রিটমেন্টের সময়, ডাক্তার ল্যাকসের জরায়ু থেকে কিছু টিস্যুর স্যাম্পল সরিয়ে নেন। তাকে ক্যান্সারের ট্রিটমেন্টের জন্য সম্মতিসূচক একটি ফর্মে সাইন করতে হয় কিন্তু টিস্যু সেম্পল সংগ্রহের ব্যাপারে তার সম্মতি নেয়া হয়নি এবং তাকে এটাও জানানো হয়নি যে তার শরীর থেকে কিছু টিস্যু নেয়া হয়েছে এবং তখন এটা অস্বাভাবিক কিছু ছিলো না। জন হপকিন্স-এর টিস্যু কালচার ল্যাবরেটরির ড. গের কাছে এ টিস্যুগুলো প্রেরণ করা হয়।।
ড. গে কয়েক দশক ল্যাবরেটরিতে হিউম্যান সেল জন্মানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু কয়েকদিন পরই সেলগুলো মারা যায়। কিন্তু ল্যাকসের সেলগুলো ছিল ইউনিক। সে এ সেলগুলোর একটিকে আলাদা করেন আর তারপর ভাগ হতে দেন আর এ প্রক্রিয়া চলতেই থাকে। তিনি এই লাইনের নাম প্রেরণ করেন HeLa! তৈরি হয় অমর কোষ। রেবেকা স্কলুটের লেখা “The Immortal Life of Henrietta Lacks ” নামে একটি বই লিখেছিলেন।
সেই বই থেকেই হেলেনের কথা প্রথম জানতে পারে বিশ্ব। রেবেকা স্কলুট এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমি বহু বছর হেনরিয়েটার ছবিটির দিকে তাকিয়ে ছিলাম, আমি বিস্মিত হয়েছিলাম তিনি কিভাবে জীবন যাপন করতেন, তার সন্তানদের সাথে কি ঘটেছিল? তিনি তার জরায়ুর কোষটি সম্পর্কে কি কখনো ভাবতে পেরেছিলেন যে এটি চিরকাল জীবিত থাকবে? একবার ভেবে দেখুন, আত্মায় বিশ্বাসীরা এখানে কি বলবেন? মৃত্যুর পরও একজন মানুষের কোষ আজ ৭০ বছর টিকে আছে, ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন কপি নিয়ে, বিশ্বের বড় বড় রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে হেনরিয়েটার কোষ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে’
হেলেন জানতেন না, তারই অজান্তে তার শরীরের কিছু সেল পোলিও ভ্যাক্সিন আবিষ্কার করবে, কোমোথেরাপিতে বিপ্লব ঘটাবে, তিনি জানতেন না তার মৃত্যুর শত বছর পর তার দেহের সেলগুলো ক্লোনিং, জিন ম্যাপিং, ভিট্রো ফার্টিলাইজেশনে একের পর এক অবদান রেখে যাবে এবং এটাও জানতেননা যে তার শরীর থেকে বেরিয়ে আসা কিছু সেল শত শত বছর পর মানব সভ্যতাকে হয়তোবা অমরত্বের দুয়ার খুলে দেবে। শাশ্বত কোষ থেকে বেরিয়ে আসবে শাশ্বত আর এক মানব সভ্যতা।
বিজ্ঞানীরা এখনও নিশ্চিতভাবে জানেন না বর্তমান পৃথিবীতে হেনরিয়েটার শরীরের ঠিক কতগুলো কোষ জীবিত। একজন বিজ্ঞানী বলেছেন, এ পর্যন্ত যে পরিমাণ হেলা কোষ তৈরি হয়েছে সেগুলোর ওজন যদি পরিমাপ করা হয় তবে তার ওজন হবে ৫০ মিলিয়ন মেট্রিক টন, যা ছিলো একটি দুর্বোধ্য সংখ্যা। একটি স্বতন্ত্র সেল যার ওজন একেবারে নাথিং, তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে আনকাউন্টেবল ট্রিলিয়ন কোষ, যেনো একদম শূন্য থেকে মহাকাশের লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি গ্রহ তারকা! এ পর্যন্ত যতগুলো হেলা কোষ নিজেদের ক্লোন তৈরি করেছে তাদেরকে যদি একের পর এক বসানো হয় তবে তারা তিনবার আমাদের পৃথিবীর চারপাশে ঘুরে আসতে পারবে যাদের স্প্যানিং হবে ৩৫০ মিলিয়ন ফুট থেকেও বেশি। ভাবুন, মাত্র ৫ ফুট লম্বা একজন নারীর শরীর থেকে বেরিয়ে আসা অত্যন্ত ক্ষুদ্র কিছু ক্যান্সার কোষ সমস্ত পৃথিবীকে তিনবার ঘিরে নিতে পারে।