Nal Sankranti: হারিয়ে যাওয়া এক লোকাচার নল সংক্রান্তি, জেনে নিন বিশেষ তথ্য

রাঢ়বঙ্গে একটি বিশেষ প্রাচীন লোকাচার হল নল সংক্রান্তি (nal sankranti)। এই বাংলার প্রাচীন প্রথাটি মূলত রাঢ় বঙ্গের কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে দেখা যায়৷

Know about nal sankranti a old ritual

রাঢ়বঙ্গে একটি বিশেষ প্রাচীন লোকাচার হল নল সংক্রান্তি (nal sankranti)। এই বাংলার প্রাচীন প্রথাটি মূলত রাঢ় বঙ্গের কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে দেখা যায়৷ কৃষিজীবী পরিবারের মানুষ হিসেবে এই প্রথা শৈশব থেকেই দেখেছি। গ্রামীণ লোকাচার নলসংক্রান্তি আর ডাকসংক্রান্তি দুটোই একই প্রথা। অঞ্চলভেদে আলাদা রকম নাম। তবে আমাদের এলাকায় এই প্রথাটিকে নলসংক্রান্তি বলে।

আশ্বিন মাসের শেষদিন অর্থাৎ সংক্রান্তির দিনে এই প্রথাটি পালিত হয়৷ এইসময় হল ধানগাছে ফসল আসার সময়, ধানগাছে ফুল হয়, ধানগাছ গর্ভবতী হয়৷ আর ধানের ভেতরের অংশটি এই সময়ে একেবারে দুধের মতো। যেটি পরবর্তী পর্যায়ে চালে পরিণত হয়। এই নরম মিষ্টি দুধ অংশটি পোকামাকড়ের খুব প্রিয়। ফলে ধানের উপর পোকামাকড়ের উপদ্রব বেড়ে যায়। এরা ধানের দুধ অংশটি শুষে নেয়। ধানের পুষ্টি হয় না। ধান থেকে চাল পাওয়া যায় না, সব আগড়া হয়। ফলে কৃষকের সর্বনাশ। কৃষক পরিবারগুলি দুঃখের সীমা থাকে না। তখন ফসল বাঁচাতে কৃষকরা ফসল এক পদ্ধতি বা টোটকা অবলম্বন করতেন পরে সেটিই প্রথা হিসেবে প্রচলিত। কৃষকরা বলতেন ধান গাছের সাধ ভক্ষন অনুষ্ঠান হল নল সংক্রান্তি।

   

আমাদের শৈশবে দেখতাম আশ্বিনের মাস শেষের আগের দিনে নল গাছ কেটে আনা হত। আমার জ্যাঠামশাইকে দেখতাম নিম, কালমেঘ, তুলসী, ওল, আদা, ভেট , বয়েড়া, মানকচু, চাল কুমড়ো খাড়া, নটে খাড়া, কেতকী, বেলপাতা, শশা গাছকে ইত্যাদি দশ বার রকমের ভেষজ খুব ছোটো ছোটো করে কুচি করতেন। তারপর আতপ চাল ও শুকনো চিংড়ি মাছ মিশিয়ে নেওয়া হত। এরপর ঐ মিশ্রণটিকে বড় পাতায় দিয়ে মুড়ে নলগাছে পাট দিয়ে তিনি বাঁধতেন। মুখে কোনো কথা বলতেন না। সারা গ্রামের চাষীরা জড়ো হতো। রাত জেগে নল বাঁধার কাজ চলত।

সংক্রান্তির দিন ভোরে সূর্যের আলো ফোটার আগেই এই মিশ্রণবাঁধা নলটি জমিতে ঈশান কোণে পুঁতে দেওয়া হত। আর বলত-
“নল পড়ল ভুঁয়ে
যা শনি তুই উত্তর মুয়ে।”
এখানে শনি অর্থাৎ সব পোকামাকড়কে বোঝানো হয়েছে। কৃষকেরা এটাকেই গর্ভবতী ধান গাছকে ‘সাধ খাওয়ানো’র কথা বলেন৷ নল সংক্রান্তিতে নলপোতা নিয়ে লোকমুখে প্রচলিত ছড়া-
অন সরিষা কাঁকুড় নাড়ি
যা রে পোক ধানকে ছাড়ি ।
এতে আছে শুকতা
ধান ফলবে মুকতা ।
এতে আছে কেঁউ
ধান হবে সাত বেঁউ ।
এতে আছে হলদি
ধান ফলবে জলদি ।
এতে আছে ওল
মহাদেবের ধ্যান করে বল হরিবোল।।

Know about nal sankranti a old ritual

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে যেটা দেখা যায় তা হল এই ফসল বাঁচানোর প্রথাটির যখন প্রচলন শুরু হয় তখন আজকের দিনের মত এত কীটনাশক ঔষধ বা রাসায়নিক সারের আবির্ভাব ঘটেনি। কীটপতঙ্গের হাত থেকে ফসল কে রক্ষা করার জন্য এই মিশ্রণটি তৈরি করা হত, এটি তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ যুক্ত ছিল যে পোকামাকড় সহজেই আর ফসলের এলাকায় আসত না। রক্ষা পেত কৃষকের ফসল৷ শুধু তাই নয়, আবার জমির মাঝে এই যে নলগাছ পুঁতে রাখা হয় সেটিতে পেঁচা প্রভৃতি প্রাণীরা এসে বসে এবং সেখান থেকে তারা খুব সহজেই ফসলের ক্ষতিকারক প্রাণীগুলিকে শিকার করে৷ পুরো ব্যাপারটিতে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষে উপকৃত হয় কৃষক৷ প্রচলিত হয় প্রথাটি।

এই সংক্রান্তির ভোরে একটি ঝুড়িতে রাখা হত ওল, হলদি, নিমপাতা, এক পুঁটলি আতপ চাল মাকে দেখতাম স্নান সেরে ওই ঝুড়ি জলে চুবিয়ে একটা পেতলের ঘটিতে জল নিয়ে ফিরতো , সেই জল দিয়ে নিমপাতা আর হলুদ বেটে খেলেই নাকি শরীরের সকল রোগ থেকে মুক্তি। দুই মেদিনীপুর জেলায় এই দিন সকালে প্রতি বাড়িতে এই নিম পাতা হলুদ আর আতপ চালের বাটা বা আলই খাওয়ার প্রথা চালু রয়েছে। এর সাথে খাওয়া হয় তাল আটির গজাড়। এদিন দুই-তিন রকমের পিঠে হয় তৈরী হয়। মধ্যাহ্ন ভোজনের সময় অন্যান্য তরিতরকারীর সাথে সাত রকমের শাক ভাজা, বিউলির ডাল,ওলের তরকারী, মাছের টক খাওয়ার প্রথা আছে।

তাছাড়া এদিন বাড়ির গরুকেও কাঁচা ও নিম পাতা খাওয়ানোর রীতি রয়েছে। যদিও আজকে এলাকার বেশিরভাগ মানুষের ধানের জমি পরিনত হয়েছে মাছ চাষের ঝিলে। যেটুকু খালি জমি আছে তাতেও বন্যার জল থৈ থৈ করছে। ঘাসের জঙ্গলে ভরে গেছে। বাংলার লোকাচার নিয়ে অনেক গল্পকথা প্রচলিত আছে পল্লীসমাজে যেগুলো সভ্যতার অগ্রগতির চাকায় পিষে যেতে যেতে ক্রমশ হারিয়ে যাবার উপক্রম। বেশিরভাগ প্রথা লোকাচার হারিয়ে গেছে আধুনিকতার দাপটে।