চুপ থাকলে-চাপ বাড়ে

মঞ্জুরুল আর চৌধুরী: নীরবতা (Silence) মানে নীরব ঘাতক। নীরবতা মানুষকে আরও দুর্বল করে দিতে পারে। আপনি যত পোষণ করবেন, আপনার মনের অস্থিরতা ততো বাড়তে থাকবে।এতে…

Silence

মঞ্জুরুল আর চৌধুরী: নীরবতা (Silence) মানে নীরব ঘাতক। নীরবতা মানুষকে আরও দুর্বল করে দিতে পারে। আপনি যত পোষণ করবেন, আপনার মনের অস্থিরতা ততো বাড়তে থাকবে।এতে আপনার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হবে।তাই দেরি না করে নিজের অসুবিধার কথা আপনার আপন জনকে জানান।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নীরবতা আপনার জীবনে মঙ্গল বয়ে নিয়ে আসে।কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে নীরবতা আপনাকে ধীরে ধীরে নিঃশেষ করে দিতে পারে। যেমন ধরুন, কোন একটা বিষয়ে আপনি সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না,সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। আবার মনে করেন, আপনার কোন কিছু করতে ভাল লাগছে না, কোন কাজে মন বসে না,একা একা থাকতে ভালো লাগে, কারো সাথে মিশতে ইচ্ছে করে না, মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকে এরকম একাধিক সমস্যা নিয়ে আপনি জীবন যাপন করছেন। সারা বিশ্বে বিশাল জনগোষ্ঠী আপনার মত চুপচাপ নীরবে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে। এই অবস্থায় আপনার নীরব থাকা একদমই উচিত নয়।

📍যে লক্ষণগুলো থাকলে আপনার চুপ থাকা উচিত নয় :
👉হঠাৎ হঠাৎ করে বেশি উত্তেজিত হয়ে ওঠা।
👉অনেকদিন ধরে নিজেকে সবার কাছ থেকে সরিয়ে গুটিয়ে রাখা।
👉টানা দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে মন খারাপ থাকা।
👉অন্যদের সঙ্গে একেবারে কথা বলতে না চাওয়া।
👉সবার সাথে ঝগড়া করা।
👉গায়েবি আওয়াজ বা কথা শুনতে পাওয়া।
👉অন্যদের অকারণে সন্দেহ করতে শুরু করা।
👉গোসল বা দাঁত মাজার মতো নিয়মিত প্রাত্যহিক কাজ করা বন্ধ করে নিজের প্রতি যত্ন না নেয়া।
👉যেসব কাজে আনন্দ পেত সেসব কাজে আগ্রহ কমে যাওয়া।
👉সামাজিক সম্পর্ক থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়া।
👉নিজেকে নিয়ে নেতিবাচক চিন্তা করা বা নিজেকে দায়ী মনে হওয়া সবকিছুতে।
👉সিদ্ধান্তহীনতা বা মনোযোগ কমে যাওয়া এবং খুব তীব্র হলে আত্মহত্যার চিন্তা,পরিকল্পনা ও চেষ্টা করে।
👉অতিরিক্ত শুচিবায়ুগ্রস্থ হয়ে ওঠা।
👉ঘুম অস্বাভাবিক কম বা বাড়তে পারে।
👉খাবারে অরুচি তৈরি হওয়া বা রুচি বেড়ে যাওয়া।
👉বাসার, অফিসের বা পেশাগত কাজের প্রতি অনীহা তৈরি হওয়া বা আগ্রহ হারিয়ে ফেলা।
📝 এর মধ্যে কোন একটা লক্ষণ টানা দুই সপ্তাহের বেশি থাকলেই আপনার সাবধান হয়ে যাওয়া উচিত। এই মুহূর্তে আপনার চুপ থাকাটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।

তাহলে একটা বাস্তব গল্প বলি: আমার এক পরিচিত বোন বেশ সম্ভ্রান্ত পরিবারের।হাজবেন্ডের সাথে সেপারেশন এর পর তার বাবার বাসায় থাকতে শুরু করলো।কিছুদিন পর সে একা একা থাকতে থাকতে তার মধ্যে যে পরিবর্তনগুলো আসলো তা হচ্ছে – প্রথমে তার ঘুম হচ্ছিল না, তারপর তার খাবারের প্রতি অরুচি দেখা দিলো,কিছুই খেতে ইচ্ছে করতো না।তারও কিছুদিন পর সে কারো সাথে কথা বলতে চাইতো না, মিশতে চাইতো না একা একা ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকতো সারাদিন।

এই অবস্থা দেখে পরিবারের সবাই ভাবলো, হাজবেন্ডের সাথে সেপারেশনের কারণে তার মন খারাপ। সবার সাথে মিশলে শপিং টপিং করলে মন ভালো হয়ে যাবে।এই জন্য তার বাবা তাকে শপিংয়ের জন্য পর্যাপ্ত টাকাও দিলো এবং বন্ধুদের নিয়ে দেশের বাইরে থেকে ঘুরে আসতে বললো। কিন্তু তার শপিং করতে , বন্ধু বান্ধবদের সাথে মিশতেও ভাল লাগেনা। সে কাউকে কিছু বলতেও পারছে না।একটা সময় সে নিরবতার বাঁধ ভেঙে যখন বললো, আমি মানসিকভাবে অসুস্থ আমার এগুলো কিছুই করতে ভাল লাগছে না,আমার সাহায্যের প্রয়োজন।তখনও তার পরিবার ব্যাপারটাকে মন খারাপ ভেবেই ধরে নিল।একটা পর্যায়ে পরিবারের সবাই ভেবে নিল হাজবেন্ডের পরিবার থেকে কেউ তাবিজ কবজ অথবা কালা যাদু টোনা করেছে।

এরপর শুরু হলো ফকির হুজুরদের বিভিন্ন ধরনের রোমাঞ্চকর কারিশমা। এভাবেই কেটে গেল ৬টা মাস। এই ছয় মাসে আত্মহত্যার চেষ্টা থেকে শুরু করে অনেক ঘটনাই ঘটেছে। একটা সময় পরিবারের সবাই চিন্তা করলো, দেশের বাইরে থেকে ঘুরে আসলে তার ভালো লাগতে পারে। সেই অনুযায়ী তারা দেশের বাইরে সিঙ্গাপুরে ঘুরতে গেল। দেশের বাইরে গিয়ে সে তার বাবা-মাকে আবার বললো, এখানে যখন এসেছি একটু ফুল বডি চেকআপটা করে যাই। বাবা-মাও তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল বডি চেকআপ এর জন্য এবং তখন সে ডাক্তারের সাথে খোলামেলা তার অসুবিধা গুলোর কথা শেয়ার করলো এবং ডাক্তার তাকে একজন সাইক্রিয়াটিক এর কাছে পাঠিয়ে দিল।

সে সময় তার বাবা-মাও বুঝতে পারলো শারীরিক অসুস্থতার মত মানুষ মানসিক ভাবেও অসুস্থ হতে পারে এবং সেটা চিকিৎসার মাধ্যমে সমাধান সম্ভব।মজার ব্যাপার হলো সেই আপুটা এখন একটা কোম্পানির চেয়ারম্যান এবং দুইটা কোম্পানির ডাইরেক্টর পদবীতে কাজ করছেন।

আমাদের দেশেও এর অনেক ভালো চিকিৎসা করা হয়। কিন্তু নানা কুসংস্কার,ভয় লজ্জা আর অসচেতনতার কারণে তা গোপন করা হয়। ফলে এই রোগীরা চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। নীরবে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে। মানসিক রোগ মোকাবিলায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সচেতনতা, যা প্রতিরোধ ও প্রতিকার উভয় ক্ষেত্রেই অত্যন্ত জরুরি।

তাই চুপ থেকে চাপ বাড়িয়ে নিজেকে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ফেলবেন না। কাছের মানুষের সাথে শেয়ার করুন এবং সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করুন প্রয়োজনে ডাক্তারের শরণাপন্ন হন।