সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়: বাংলা আজ যা ভাবে বাকি ভারত আগামিকাল তা ভাবে – এই প্রবাদটা বোধহয় আর খাটে না ৷ বরং বেশ কিছু দিন যাবৎ বাঙালিকে ভারতের অন্য অঞ্চলকে অনুকরণ করতে দেখা যাচ্ছে ৷ এরফলে ভিন রাজ্যের সংস্কৃতি খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে গিয়েছে বাংলার আঙিনায়৷ হিন্দু- হিন্দি- হিন্দুস্তান স্লোগানের যতই বিরোধিতা করা হোক না কেন তা রাজনৈতিক এবং সামাজিক দিক দিয়ে ক্রমশ বিস্তার করছে নানা ভাবেই এই বাংলায়৷ যেখানে ২৫-৩০ বছর আগে কলকাতায় ধনতেরাস নিয়ে তেমন কোনও মাতামাতি না থাকলেও ইদানীং অবাঙালিদের প্রভাবে এই উৎসব বঙ্গজীবনের অঙ্গ হয়ে উঠেছে৷ আবার চিরাচরিত বাংলার আলপনাকে গ্রাস করে রঙ্গোলি ঢুকে পড়তে চাইছে বাঙালির অন্দরে৷রঙ্গোলি সংস্কৃতি মূলত উত্তর ভারত-কেন্দ্রিক। যদিও ইদানীং দেখা যাচ্ছে কলকাতার সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার অঙ্গ হয়ে উঠছে আলপনার এমন বিকল্প রূপটি।
বলা মুশকিল এটা বিশ্বায়ন মুক্ত অর্থনীতির প্রভাব , না কি সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তারের লড়াই? তবে সমাজ সংস্কৃতির উপর প্রভাব বিস্তারের পিছনে লুকিয়ে থাকে একটা অর্থকরী দিক ৷ কারণ ধনতেরাস এবং রঙ্গোলি ঘিরে একটা বাজার রয়েছে সেটা তো অস্বীকার করা যায় না ৷ সিকি শতাব্দী আগেও বাঙালি তেমন ভাবে ধনতেরাসের উপলক্ষ্যে হুমড়ি খেয়ে সোনা রূপা অথবা কোনও ধাতু কেনায় মেতে উঠত না ৷ বরং আগে তো পয়লা বৈশাখ কিংবা অক্ষয় তৃতীয়ার দিন বাঙালিকে সোনা কিনতে দেখা যেত ৷ তার বদলে এখন ধনতেরাসের দিনটাকে বেছে নিচ্ছে ৷ পয়লা বৈশাখ কিংবা অক্ষয় তৃতীয়ার চেয়ে ধনতেরাসের দিনে বাংলাতেও সোনার দোকানে রেশন দোকানের মতো লম্বা লাইন পড়ে৷ চলে মধ্য রাত পর্যন্ত কেনা কাটা৷ আর এরই পাশাপাশি বাঙালি জীবনযাত্রায় নতুন সংযোজন হয়েছে রঙ্গোলির আবির্ভাব৷ জীবনের গতি বেড়েছে বিশ্বায়নের প্রভাবই বা অগ্রাহ্য করা যায় কেমন করে- ফলে এমন ফাস্টলাইফ-এর যুগে আলপনার দেওয়ার অনেক হ্যাপা তার চেয়ে বরং রঙ্গোলি অনেক গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে বাংলার একদল মানুষের কাছে৷ ফলে ঘরে ঘরে এতদিনের আলপনা মুছে দিয়ে রঙ্গোলিতে সেজে উঠছে৷
যদিও পুজো পার্বন উৎসবে ঘর সাজাতে সারা রাত চালের গুঁড়ো ভিজিয়ে রেখে সকালে সেটাকে বেটে তাই দিয়ে আলপনা দেওয়ার রেওয়াজ তো এই বঙ্গে হাজার বছরেরও বেশি পুরনো ৷ সেই ঐতিহ্য ইদানিং কেমন যেন ধাক্কা খেতে বসেছে। এ যুগটা বড্ড বেশি চটজলটি কাজের যুগ হয়ে উঠছে ৷ সব কিছু রেডিমেড পেতে চাইছেন অনেকেই ৷ সেদিক থেকে আলপনার তুলনায় রঙ্গোলি অনেকের কাছে সহজলভ্য ও সুবিধাজনক মনে হচ্ছে ৷ আলপনার মতো অত কসরৎ করতে হয় না রঙ্গোলিতে ৷ নানা রংয়ের গুঁড়ো রেডিমেড নকশাকাটা ছাঁচের মধ্যে দিয়ে ঢেলে দিলেই কাজ শেষ। আপনার সামনে মেঝেতে ঝকঝক করছে চোখধাঁধানো রঙ্গোলি। সময় লাগবে মাত্র কয়েকটা মিনিট। আবার ঝাড়ু দিলেই মুহূর্তে সাফ। মেঝে আবার আগের মতোই হয়ে যাবে। আর দেখা যাচ্ছে কালী পুজোর সময় কলকাতার হরেক বাজারে উঁকি দিতে শুরু করছে রঙ্গোলির নানা ধরনের প্যাকেট। রঙ্গোলির প্যাকেট আগে মূলত অবাঙালিদের কিনতে দেখা গেলেও ইদানিং কিছু কিছু বাঙালিকেও দেখা যাচ্ছে ৷ আলপনার দেওয়ার জন্য যে সময় ও দক্ষতার দরকার হয় একদল বাঙালির কাছে সেটারই বড্ড অভাব আজ ৷ এই কারণেই রঙ্গোলি বলে নয় কয়েক বছর আগে আলপনার স্টিকার বাজারে আসতে দেখা গিয়েছিল।
এখন ধনতেরাসের দিনে শুধু সোনা-রূপা কেনা বলে নয় তুলনায় কম দামের কোনও ধাতু (কাঁসা, পেতল ইত্যাদি) কেনার প্রবণতা দেখা যায়৷ তবে উৎসব সংস্কৃতিকে এভাবে মানুষের মনে গেঁথে দিতে বাজার অর্থনীতির একটা ভূমিকা অবশ্যই থাকে৷ যেমন ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল এই ধনতেরাস সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগাতে চায় সোনা কেনার প্রবণতার বাড়ানোর জন্য৷ তেমনই আবার দেখা যাচ্ছে সহজে ব্যবহার যোগ্য এই রঙ্গোলির বিক্রির পরিধিও গত কয়েক বছর ধরে বাড়ছে৷
বাংলা ভাষার নাকি তেমন অর্থকরী মর্যাদা নেই বলে ইদানিং বহু বাঙালি অভিভাবকের মনে হয়েছে , তাই তো তাদের সন্তানদের স্কুলে বাংলার বদলে ইংরেজি এবং হিন্দি শেখানোর দিকে উৎসাহী হতে দেখা যাচ্ছে ৷ এই যদি অবস্থা হয় তাহলে ধনতেরাস এবং রঙ্গোলি বঙ্গজীবনে শিকড় বিস্তার করতেই পারে ৷ তবে শহরাঞ্চলে যেভাবে রঙ্গোলির ‘অনুপ্রবেশ’ ঘটেছে সেই তুলনায় গ্রাম বাংলায় তার দাপট এখনও কম ৷ বিশেষত কলকাতা থেকে কয়েকশো কিলোমিটার দূরে বাঁকুড়া বা পুরুলিয়ার আদিবাসী গ্রামগুলিতে এখনও আলপনা স্বমিহমায় বিরাজ করছে। তাহলে বঙ্গজীবনে এই অনুপ্রবেশ আটকাতে কি গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরা শুরু করতে হবে ?