শুক্রবার সকালে সুপ্রিম কোর্ট ভারত সরকারকে একটি গুরুত্বপূর্ণ নোটিশ জারি করে একটি বিস্ময়কর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই নোটিশটি দেওয়া হয়েছে রাম সেতুকে (Ram Setu) জাতীয় স্মারক হিসেবে ঘোষণা করার দাবি উত্থাপন করে একটি আবেদনের প্রেক্ষাপটে। প্রাক্তন রাজ্যসভা সদস্য ড. সুব্রমণিয়ন স্বামী কর্তৃক দায়ের করা এই রিট পিটিশনের পর সুপ্রিম কোর্ট এই ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছে। এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তটি দেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে উৎসাহ ও বিতর্কের সৃষ্টি করেছে, বিশেষ করে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে গৃহীত হয়েছে।
রাম সেতু কী?
রাম সেতু, যাকে আদমের সেতুও বলা হয়, হলো ভারতের তামিলনাড়ুর রামেশ্বরম দ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার মান্নার দ্বীপের মধ্যে অবস্থিত একটি প্রাকৃতিক চুনাপাথরের শিলা সারি। হিন্দু ধর্মের প্রাচীন গ্রন্থ রামায়ণ অনুযায়ী, এই সেতুটি প্রভু রামচন্দ্রের নির্দেশে বানর সেনার সাহায্যে নির্মিত হয়েছিল, যাতে তিনি লঙ্কায় গিয়ে সীতাকে রাবণের কবল থেকে উদ্ধার করতে পারেন। গীর্জা সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার গবেষণা অনুযায়ী, এই সেতু প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠেছে এবং সর্বোচ্চ গভীরতা মাত্র ১ থেকে ৩ মিটার। গত হোলোসিন যুগে সমুদ্রের পানি বৃদ্ধির ফলে এটি পানির নিচে ডুবে গিয়েছিল, তবে এর ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব অক্ষুণ্ণ রয়ে গেছে।
Also Read | Pok ট্রফির ম্যাচ হোক LoCতে, ক্রিকেট নিয়ে বিস্ফোরক অভিষেক
সুপ্রিম কোর্টের নোটিশের পটভূমি
এই আবেদনটি প্রথমে ২০০৭ সালে ড. সুব্রমণিয়ন স্বামী কর্তৃক দায়ের করা হয়েছিল, যখন তিনি সেথুসমুদ্রাম শিপ চ্যানেল প্রকল্পের বিরুদ্ধে পিআইএল করেন। এই প্রকল্পটির উদ্দেশ্য ছিল ভারত ও শ্রীলঙ্কার মধ্যবর্তী পালক সাগরে একটি নৌপথ তৈরি করা, যা রাম সেতুকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারত। পরিবেশবাদী ও ধর্মীয় গোষ্ঠীরা এই প্রকল্পের বিরোধিতা করেছিলেন, কারণ এটি সমুদ্রের জীবজগৎ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে। সুপ্রিম কোর্ট ২০০৭ সালে এই প্রকল্পের কাজ স্থগিত করেছিল, এবং এখন আবার এই বিষয়টি উঠে এসেছে। আজকের নোটিশটি এই পুরনো বিতর্ককে পুনরুজ্জীবিত করেছে।
সামাজিক প্রতিক্রিয়া
সুপ্রিম কোর্টের এই সিদ্ধান্তের পর সোশ্যাল মিডিয়া, বিশেষ করে এক্স প্ল্যাটফর্মে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। @MeghUpdates এর পোস্টটি ভাইরাল হয়ে উঠেছে, যেখানে তিনি এই ব্রেকিং নিউজটি শেয়ার করেছেন। অনেকে এটিকে সনাতনীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে দেখছেন। @SoodSaab11 এর মতে, রাম সেতু কেবল পাথরের স্তূপ নয়, এটি শ্রী রামের চিরন্তন পথের প্রতীক। অন্যদিকে, কিছু ব্যক্তি পরিবেশ ও ঐতিহাসিক গুরুত্বের দিক থেকে এর রক্ষণাবেক্ষণের পক্ষে মতামত দিয়েছেন। তবে, এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করতে পারে এমন কিছু গোষ্ঠীও রয়েছে, যারা মনে করেন যে এটি অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
পরিবেশ ও অর্থনৈতিক প্রভাব
রাম সেতু এলাকা একটি গুরুত্বপূর্ণ মাছ ধরার জায়গা এবং গালফ অফ মান্নার মেরিন ন্যাশনাল পার্কের কাছাকাছি অবস্থিত। সেথুসমুদ্রাম প্রকল্পের পরিকল্পিত রুটটি সমুদ্রের প্রাণীজগৎ ও প্রবাল প্রাচীর নষ্ট করতে পারে, যা তামিলনাড়ুর মাছশিকারী সম্প্রদায়ের জীবিকাকে প্রভাবিত করবে। উপরন্তু, শঙ্খ শামুকের বাণিজ্য, যা প্রতি বছর প্রায় ১৫০ কোটি টাকার মতো আয় সৃষ্টি করে, এটিও বিপন্ন হতে পারে। তবে, প্রকল্পের সমর্থকরা মনে করেন যে একটি নতুন নৌপথ ভারতের বাণিজ্যকে উন্নত করতে পারে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
সুপ্রিম কোর্টের নোটিশের পর এখন কেন্দ্রীয় সরকারের উপর নির্ভর করছে যে তারা কীভাবে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। যদি রাম সেতুকে জাতীয় স্মারক হিসেবে ঘোষণা করা হয়, তবে এটি পর্যটন শিল্পে একটি নতুন দিগন্ত খুলতে পারে এবং এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব রক্ষিত হবে। তবে, এর সঙ্গে জড়িত পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলোও সমাধান করতে হবে। এই বিষয়ে বিজ্ঞানী, ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় নেতাদের মতামত গ্রহণ করে একটি সুষ্ঠু সমাধান খুঁজে বের করা জরুরি।
সামগ্রিকভাবে, রাম সেতু নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যা ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও পরিবেশ রক্ষার মধ্যে একটি সামঞ্জস্য স্থাপনের চেষ্টা হিসেবে দেখা যাচ্ছে। এটি কেবল একটি ধর্মীয় প্রতীক নয়, বরং একটি প্রাকৃতিক অভিযান যা অতীতের সঙ্গে বর্তমানের সংযোগ স্থাপন করে।