নয়াদিল্লি: ওয়াশিংটনের চাপ সত্ত্বেও অব্যাহত ভারতের তেল অভিযান। সূত্রের খবর অনুযায়ী জানা গিয়েছে সবচেয়ে বড় তেল পরিশোধনকারী কোম্পানি ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশন (আইওসি) আবারও রাশিয়ান ক্রুড অয়েল কিনতে শুরু করেছে। এবারের ক্রয় হয়েছে নন-স্যাঙ্কশনড এনটিটি বা নিষিদ্ধ সত্ত্বগুলো থেকে, যা আমেরিকার চোখরাঙানির বিরুদ্ধে ভারতের স্পষ্ট বার্তা।
রয়টার্সের একটি রিপোর্ট অনুসারে, আইওসি ডিসেম্বর মাসের জন্য পাঁচটি কার্গো রাশিয়ান তেলের অর্ডার দিয়েছে, যা প্রায় ৩.৫ মিলিয়ন ব্যারেলের সমান। এই তেলের মধ্যে বেশিরভাগই ইসপিও (ইস্টার্ন সাইবেরিয়া-প্যাসিফিক ওশান) ধরনের, যা দুবাইয়ের কোটেশনের সমান দামে কেনা হয়েছে এবং পূর্ব ভারতের একটি বন্দরে পৌঁছাবে।
Honda Elevate-এর নতুন এডিশন পেল দুর্ধর্ষ ডিজাইন, প্রকাশ্যে টিজার
এই খবরটি আসছে এমন সময়ে যখন মার্কিন সরকার রাশিয়ার এনার্জি রাজস্ব কমানোর জন্য ভারতকে চাপ দিচ্ছে, বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে।এই ঘটনার পটভূমি খুবই জটিল এবং ভূ-রাজনৈতিক। গত সপ্তাহেই ওয়াশিংটন রাশিয়ার দুটি সবচেয়ে বড় তেল কোম্পানি রোসনেফট এবং লুকঅয়েলের উপর নতুন স্যাঙ্কশন জারি করেছে। এই স্যাঙ্কশনগুলোর উদ্দেশ্য স্পষ্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নেতৃত্বাধীন ক্রেমলিনকে ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে পিছু হটতে বাধ্য করা।
মার্কিন ট্রেজারি বিভাগের নির্দেশ অনুসারে, বিশ্বব্যাপী ক্রেতাদের ২১ নভেম্বরের মধ্যে এই কোম্পানিগুলোর সঙ্গে লেনদেন বন্ধ করে দিতে হবে। এর ফলে ভারতের অনেক রিফাইনারি, যেমন ম্যাঙ্গালোর রিফাইনারি অ্যান্ড পেট্রোকেমিক্যালস লিমিটেড (এমআরপিএল), এইচপিসিএল-মিত্তাল এনার্জি লিমিটেড এবং রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ—যারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় রিফাইনিং কমপ্লেক্স পরিচালনা করে—রাশিয়ান তেল কেনা স্থগিত করেছে।
আইওসি নিজেও গত সপ্তাহে সাত থেকে আটটি শিপমেন্ট ক্যানসেল করেছিল, কারণ সেগুলো নতুন স্যাঙ্কশনড সাবসিডিয়ারিগুলোর সঙ্গে যুক্ত ছিল। কিন্তু এখন তারা সতর্কতার সঙ্গে নন-স্যাঙ্কশনড সাপ্লায়ারদের থেকে ক্রয় শুরু করেছে, যা স্যাঙ্কশনের সীমানা না অতিক্রম করে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার একটি কৌশলগত পদক্ষেপ।আইওসির ফাইন্যান্স হেড অনুজ জৈনের বক্তব্য এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, “যতদিন না লেনদেন স্যাঙ্কশনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, ততদিন আমরা রাশিয়ান তেল কিনতে থাকব।” এটি শুধুমাত্র একটি কর্পোরেট স্ট্যাটমেন্ট নয়, বরং ভারত সরকারের অবস্থানকেও প্রতিফলিত করে। নয়াদিল্লি দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে যে, রাশিয়ান তেল কেনা ভারতের এনার্জি সিকিউরিটির জন্য অপরিহার্য। বিশ্বের দ্রুত বাড়তে থাকা তেলের চাহিদা মেটাতে এবং দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে এই ডিসকাউন্টেড তেল একটি বড় সুবিধা।
গত তিন বছরে স্যাঙ্কশনের কারণে রাশিয়া তার তেল বিশাল ছাড়ে বিক্রি করছে, এবং ভারত এর সবচেয়ে বড় ক্রেতা হয়ে উঠেছে। রাশিয়ান সাগরপথে রফতানি হওয়া ক্রুডের প্রায় ৪০ শতাংশ এখন ভারতে আসছে, যা দেশের তেল আমদানির মোট পরিমাণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। এই ক্রয়ের ফলে ভারতের রিফাইনারিগুলো খরচ কমিয়ে লাভবান হচ্ছে, যা শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদের কাছে পেট্রোল-ডিজেলের দাম নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
কিন্তু এই সিদ্ধান্তের পিছনে শুধু অর্থনৈতিক সুবিধাই নয়, ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্যও রয়েছে। মার্কিন চাপ বাড়ছে ঠিক এমন সময়ে যখন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতকে রাশিয়ান তেল কেনা বন্ধ করার জন্য সরাসরি বলছেন।
গ্রীষ্মকালে মার্কিন সরকার ভারতীয় রফতানির উপর ট্যারিফ বাড়িয়েছে, যা একটি পরোক্ষ চাপের কৌশল। ট্রাম্পের সাম্প্রতিক চীনের সঙ্গে আলোচনায়ও রাশিয়ান তেলের বিষয় উঠে এসেছে, যেখানে তিনি ভারতের ভূমিকাকে প্রশংসা করলেও চাপ কমাননি।
ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে, এটি একটি ডেলিকেট ব্যালেন্সিং অ্যাক্ট। একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোয়াড (কোয়াড্রিল্যাটেরাল সিকিউরিটি ডায়লগ) এবং অন্যান্য কৌশলগত অংশীদারিত্ব, অন্যদিকে রাশিয়ার সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী সম্পর্ক এবং এনার্জি নির্ভরতা। নয়াদিল্লি জোর দিয়ে বলছে যে, তারা কোনো স্যাঙ্কশন ভঙ্গ করছে না, বরং আন্তর্জাতিক আইনের মধ্যেই থেকে ব্যবসা করছে। এটি একটি স্মার্ট ডিপ্লোম্যাসি, যা দেখাচ্ছে ভারত কীভাবে তার স্বাধীনতা বজায় রাখছে।


