২০২৪ সালে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে দুর্ঘটনা সংক্রান্ত ‘বিস্ফোরক’ তথ্য নয়াদিল্লির

ভারতের অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিগুলিতে (Ordnance Factories) ২০২৪ সালে ৬২টি শিল্প দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে সোমবার সংসদে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের রাষ্ট্রমন্ত্রী সঞ্জয় সেথ এই তথ্য প্রকাশ…

Ordnance Factories in india

ভারতের অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিগুলিতে (Ordnance Factories) ২০২৪ সালে ৬২টি শিল্প দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে সোমবার সংসদে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের রাষ্ট্রমন্ত্রী সঞ্জয় সেথ এই তথ্য প্রকাশ করেছেন। কংগ্রেস সাংসদ রণদীপ সিং সুরজেওয়ালা গত পাঁচ বছরে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে শিল্প দুর্ঘটনা ও বিস্ফোরণের সংখ্যা জানতে চেয়ে একটি প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন। মন্ত্রী তার লিখিত জবাবে জানান, ২০২৪ সালে ৬২টি দুর্ঘটনা রিপোর্ট করা হয়েছে। এছাড়া, ২০২৩ সালে ৭৫টি, ২০২২ সালে ৮৩টি, ২০২১ সালে ৭৪টি এবং ২০২০ সালে ৫৪টি দুর্ঘটনা ঘটেছিল। এই তথ্য অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিগুলির নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে।

short-samachar

   

অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিগুলি, যা এখন ডিফেন্স পাবলিক সেক্টর আন্ডারটেকিংস (ডিপিএসইউ) হিসেবে পরিচিত, ভারতের প্রতিরক্ষা বাহিনীর জন্য অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং অন্যান্য সরঞ্জাম তৈরি করে। এই ফ্যাক্টরিগুলিতে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাগুলি শ্রমিকদের জীবন ও নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২৫ সালের এই সময়ে, যখন আমরা শিল্প নিরাপত্তার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করছি, এই পরিসংখ্যানগুলি সরকারের দায়িত্বশীলতা এবং নীতির উপর আলোকপাত করছে।

দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান: একটি উদ্বেগজনক চিত্র
মন্ত্রী সঞ্জয় সেথের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে মোট ৩৪৮টি শিল্প দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২০২২ সালে সবচেয়ে বেশি ৮৩টি দুর্ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে, যেখানে ২০২০ সালে সংখ্যাটি ছিল সর্বনিম্ন—৫৪টি। ২০২৪ সালে ৬২টি দুর্ঘটনা ঘটলেও এটি এখনও উদ্বেগজনক। এই দুর্ঘটনাগুলির মধ্যে বিস্ফোরণ, আগুন এবং যন্ত্রপাতি ত্রুটির কারণে শ্রমিকদের মৃত্যু ও আহত হওয়ার ঘটনা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

২০২১ সালে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি বোর্ড (ওএফবি) ভেঙে সাতটি ডিপিএসইউ-তে রূপান্তরিত হওয়ার পরও দুর্ঘটনার সংখ্যা কমেনি। এই পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায় যে শিল্প নিরাপত্তা এবং কর্মীদের প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে এখনও অনেক উন্নতি করা প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই দুর্ঘটনাগুলি কেবল যান্ত্রিক ত্রুটির ফল নয়, বরং নিরাপত্তা প্রোটোকলের অপর্যাপ্ত বাস্তবায়ন এবং শ্রমিকদের অপ্রতুল প্রশিক্ষণের কারণেও ঘটছে।

সরকারের জবাব ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা
রণদীপ সিং সুরজেওয়ালার প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী সেথ জানিয়েছেন, এই দুর্ঘটনায় আহত বা নিহত শ্রমিকদের জন্য ক্ষতিপূরণ এবং সহায়তা ‘এমপ্লয়িজ কমপেনসেশন অ্যাক্ট, ১৯২৩’-এর অধীনে প্রদান করা হয়। ডিপিএসইউ-গুলির নীতি অনুযায়ী আর্থিক সাহায্য বা এক্স-গ্রেশিয়া পেমেন্টও দেওয়া হয়। তবে, শ্রমিক সংগঠনগুলি দাবি করছে যে এই ক্ষতিপূরণ প্রায়ই পর্যাপ্ত হয় না এবং দুর্ঘটনার পর শ্রমিকদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য সরকারের কাছে পরিকল্পনা নেই।

মন্ত্রী আরও জানান, অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিগুলিতে নিরাপত্তা মান নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘সেন্টার ফর ফায়ার, এক্সপ্লোসিভস অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট সেফটি’ (সিএফইইএস)-এর নির্দেশিকা অনুসরণ করা হয়। নিয়মিত নিরাপত্তা অডিট এবং পর্যালোচনার মাধ্যমে এই মান বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়। তবে, শ্রমিক নেতারা অভিযোগ করেছেন যে এই অডিটগুলি প্রায়ই আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয় এবং বাস্তবে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয় না।

শ্রমিকদের ক্ষোভ ও সমালোচনা
এই তথ্য প্রকাশের পর শ্রমিক সংগঠন এবং বিরোধী দলগুলি সরকারের সমালোচনায় মুখর হয়েছে। ভারতীয় প্রতিরক্ষা মজদুর সংঘের কর্মকর্তা মুকেশ সিং বলেন, “এই দুর্ঘটনাগুলি একক ঘটনা নয়। নিরাপত্তা প্রোটোকলের প্রতি উদাসীনতা এবং কর্মীদের উপর অতিরিক্ত চাপ এই সমস্যার মূল কারণ।” তিনি আরও বলেন, “৪১টি অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে নিয়মিত নিরাপত্তা ড্রিল এবং কঠোর প্রোটোকল মানা উচিত, কিন্তু সময়ের সঙ্গে এগুলো শিথিল হয়ে পড়েছে।”

গত জানুয়ারি মাসে মহারাষ্ট্রের ভান্ডারায় একটি অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে বিস্ফোরণে ৮ জন শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনা এখনও মানুষের মনে তাজা। শ্রমিকরা অভিযোগ করেছেন, কর্পোরেটাইজেশনের পর উৎপাদনের চাপ বাড়ায় নিরাপত্তার প্রতি আরও উপেক্ষা করা হচ্ছে। “আমাদের প্রাণের দাম নেই। লাভের জন্য আমাদের জীবন বিপন্ন করা হচ্ছে,” বলেন এক শ্রমিক নেতা।

রাজনৈতিক বিতর্ক
কংগ্রেস সাংসদ সুরজেওয়ালা এই তথ্যের ভিত্তিতে সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, “প্রতিরক্ষা শিল্পে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। এত দুর্ঘটনা ঘটলেও কোনো কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।” বিরোধী দলগুলি দাবি করছে, এই ঘটনাগুলি সরকারের শিল্প নীতি এবং শ্রমিকদের প্রতি অবহেলার প্রমাণ।

অন্যদিকে, সরকারের সমর্থকরা বলছেন, এই দুর্ঘটনাগুলি শিল্পের স্বাভাবিক ঝুঁকির অংশ এবং সরকার নিরাপত্তা জোরদারে কাজ করছে। তবে, এই যুক্তি শ্রমিকদের ক্ষোভ কমাতে পারেনি।

শিল্প দুর্ঘটনার বৃহত্তর প্রেক্ষাপট
ভারতে শিল্প দুর্ঘটনা কোনো নতুন সমস্যা নয়। ২০২১ সালে শ্রম মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, গত পাঁচ বছরে কারখানা, বন্দর, খনি এবং নির্মাণ ক্ষেত্রে ৬,৫০০ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। শ্রমিক ইউনিয়নগুলি দাবি করে, প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি, কারণ অনেক ঘটনা রিপোর্ট করা হয় না। অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির এই দুর্ঘটনাগুলি এই সমস্যার একটি অংশ মাত্র।

২০২৪ সালে ইন্ডাস্ট্রিঅল গ্লোবাল ইউনিয়নের তথ্য অনুযায়ী, ভারতের উৎপাদন, খনি এবং শক্তি খাতে ২৪০টি দুর্ঘটনায় ৪০০ জনেরও বেশি শ্রমিক নিহত এবং ৮৫০ জন গুরুতর আহত হয়েছেন। এই পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায়, শিল্প নিরাপত্তা এখনও ভারতের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে দুর্ঘটনা কমাতে নিয়মিত প্রশিক্ষণ, আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং কঠোর নিরাপত্তা নিরীক্ষণ জরুরি। শ্রমিকদের উপর উৎপাদনের চাপ কমিয়ে তাদের নিরাপত্তার দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত। সরকারের উচিত এই দুর্ঘটনার তদন্ত করে দায়ীদের শাস্তি দেওয়া এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনা রোধে কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করা।

২০২৪ সালে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে ৬২টি দুর্ঘটনার তথ্য শ্রমিকদের নিরাপত্তা এবং শিল্প ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাকে তুলে ধরেছে। এই পরিসংখ্যান শুধু সংখ্যা নয়, এর পিছনে রয়েছে শ্রমিকদের জীবন ও তাদের পরিবারের দুঃখ। ২০২৫ সালে এই সময়ে, সরকারের কাছে প্রত্যাশা থাকবে যে তারা এই সমস্যার সমাধানে দ্রুত এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। শ্রমিকদের জীবন রক্ষা এবং শিল্প নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।