কাশ্মীরে পর্যটকদের উপর পাক-জঙ্গি হামলায় মৃত্যু ২৭

জম্মু ও কাশ্মীরের দক্ষিণ কাশ্মীরের পাহলগামের (Pahalgam ) বাইসারান উপত্যকায় মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল, ২৫) দুপুরে লস্কর-ই-তৈবা (এলইটি)-এর সঙ্গে যুক্ত একদল সন্ত্রাসী পর্যটকদের উপর ভয়াবহ হামলা…

Pahalgam Terror Attack

জম্মু ও কাশ্মীরের দক্ষিণ কাশ্মীরের পাহলগামের (Pahalgam ) বাইসারান উপত্যকায় মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল, ২৫) দুপুরে লস্কর-ই-তৈবা (এলইটি)-এর সঙ্গে যুক্ত একদল সন্ত্রাসী পর্যটকদের উপর ভয়াবহ হামলা চালায়। এই হামলায় ২৭ জন নিহত এবং অনেকে আহত হয়েছেন। ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ নামে একটি গোষ্ঠী সামাজিক মাধ্যমে একটি পোস্টের মাধ্যমে এই হামলার দায় স্বীকার করেছে, যেখানে একজন আহত পর্যটকের ছবিও প্রকাশ করা হয়েছে। এই ঘটনা কাশ্মীরের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলাগুলির মধ্যে একটি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

হামলাটি মঙ্গলবার দুপুর আনুমানিক ২:৩০-এ শুরু হয়, যখন পর্যটকরা বাইসারানের মনোরম তৃণভূমিতে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরছিলেন। বাইসারান, যাকে প্রায়ই ‘মিনি সুইৎজারল্যান্ড’ বলা হয়, তার সবুজ তৃণভূমি এবং পাইন বনের জন্য পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। একজন আহত পর্যটক জানিয়েছেন, সামরিক পোশাক পরা দুজন সন্ত্রাসী তাদের উপর অতর্কিতে গুলি চালায়। হামলায় নারী ও বয়স্ক ব্যক্তিরাও আক্রান্ত হয়েছেন। একজন পর্যটক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে মারা যান। শীর্ষ গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, হামলায় ৪ থেকে ৬ জন সন্ত্রাসী জড়িত ছিল, যাদের মধ্যে তিনজন বিদেশি এবং একজন স্থানীয় কাশ্মীরি। ঘটনাস্থল থেকে এম৪ এবং একে-৪৭ রাইফেলের গুলি উদ্ধার করা হয়েছে।

   

হামলায় কমপক্ষে দুজন বিদেশি নাগরিক নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে একজন ইসরায়েলি এবং একজন ইতালীয় পর্যটক রয়েছেন। গোয়েন্দা সূত্রের মতে, মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে, এবং এটি কাশ্মীরে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী হামলা হতে পারে। হামলাকারীরা প্রথমে পুরুষ পর্যটকদের লক্ষ্য করে গুলি চালায় বলে জানা গেছে। একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, সন্ত্রাসীরা কাছ থেকে গুলি চালিয়েছে, যার ফলে পর্যটকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এলাকাটি পায়ে হাঁটা বা ঘোড়ায় চড়ে পৌঁছানো যায়, যা উদ্ধার কাজকে জটিল করে তুলেছে।

হামলার পরপরই নিরাপত্তা বাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছে এলাকাটি ঘিরে ফেলে। তারা সতর্কতার সঙ্গে তল্লাশি অভিযান শুরু করেছে, কারণ গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, সন্ত্রাসীরা নিরাপত্তা বাহিনীকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করতে পারে। জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ)-এর একটি দল তল্লাশি অভিযান শেষ হওয়ার পর পাহলগামে পৌঁছাবে বলে জানা গেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা আহতদের ঘোড়ায় করে তৃণভূমি থেকে নামিয়ে আনতে সাহায্য করেছে, এবং হেলিকপ্টারের মাধ্যমে আহতদের স্থানান্তর করা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে হামলার বিষয়ে অবহিত করেছেন এবং তিনি শ্রীনগরে পৌঁছে উচ্চ-পর্যায়ের নিরাপত্তা পর্যালোচনা বৈঠক করছেন। প্রধানমন্ত্রী মোদী সামাজিক মাধ্যমে এক পোস্টে বলেছেন, “পাহলগামে সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা জানাই। যারা এই জঘন্য কাজের পিছনে রয়েছে, তাদের ছাড়া হবে না। আমাদের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সংকল্প অটুট এবং আরও দৃঢ় হবে।” শাহও এক পোস্টে বলেছেন, “এই কাপুরুষোচিত হামলার জন্য দায়ীদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে।”

জম্মু ও কাশ্মীরের লেফটেন্যান্ট গভর্নর মনোজ সিনহা আহতদের জন্য তাৎক্ষণিক চিকিৎসার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, “এই ঘৃণ্য হামলার পিছনে যারা রয়েছে, তাদের শাস্তি থেকে রেহাই দেওয়া হবে না। আমি ডিজিপি ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। সেনাবাহিনী এবং জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে তল্লাশি অভিযান শুরু করেছে।”

জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ এই হামলাকে ‘অভূতপূর্ব’ এবং ‘জঘন্য’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, “আমি এই ঘটনায় স্তম্ভিত। আমাদের পর্যটকদের উপর এই হামলা একটি জঘন্য কাজ। এই হামলাকারীরা অমানুষ এবং নিন্দার যোগ্য। কোনো নিন্দার ভাষাই এই কাজের জন্য যথেষ্ট নয়। মৃতদের পরিবারের প্রতি আমার সমবেদনা।”

কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী হামলার নিন্দা করে বলেছেন, “পাহলগামে পর্যটকদের মৃত্যু এবং অনেকের আহত হওয়ার খবর অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং হৃদয়বিদারক। আমি শোকাহত পরিবারগুলির প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করি।” জম্মু ও কাশ্মীর পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) নেত্রী মেহবুবা মুফতি এবং জম্মু ও কাশ্মীর পিপলস কনফারেন্সের (পিসি) নেতা সাজ্জাদ লোনও এই হামলার তীব্র নিন্দা করেছেন। মুফতি বলেন, “কাশ্মীর ঐতিহ্যগতভাবে পর্যটকদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে এসেছে, তাই এই ঘটনা গভীর উদ্বেগের। এই হামলার পিছনে দায়ীদের বিচার করতে এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার ত্রুটি খতিয়ে দেখতে পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত প্রয়োজন।”

এই হামলা কাশ্মীরের পর্যটন শিল্পের জন্য বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা হচ্ছে, যেখানে ২০২৪ সালে প্রায় ৩৫ লক্ষ পর্যটক এসেছিলেন। হামলাটি অমরনাথ যাত্রার আগে ঘটেছে, যা ৩ জুলাই থেকে শুরু হবে। এই সময়ে পাহলগাম পর্যটকদের ভিড়ে মুখরিত থাকে। সাজ্জাদ লোন বলেন, “এই সন্ত্রাসীরা কাশ্মীরের আতিথেয়তার বিরুদ্দ্বে লড়ছে। তারা চায় পর্যটকরা কাশ্মীর ছেড়ে চলে যাক, যাতে কাশ্মীরিদের জীবিকা নষ্ট হয়।”

ইসরায়েলের ভারতীয় দূতাবাসের মুখপাত্র গাই নির এই হামলার নিন্দা করে বলেন, “ইসরায়েল ভারতের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একত্রিত।” আর্জেন্টিনার ভারতীয় রাষ্ট্রদূত মারিয়ানো কাউসিনোও এই হামলাকে ‘জঘন্য’ বলে নিন্দা করেছেন।

পাহলগামের এই সন্ত্রাসী হামলা কাশ্মীরের শান্তি ও পর্যটন শিল্পের উপর গভীর আঘাত হেনেছে। নিরাপত্তা বাহিনী এবং সরকারের তরফে কঠোর পদক্ষেপের আশ্বাস দেওয়া হলেও, এই ঘটনা জাতীয় নিরাপত্তা এবং পর্যটকদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসনকে এখন কাশ্মীরের পর্যটন শিল্পে আস্থা ফিরিয়ে আনতে এবং ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে

Advertisements