নির্বাচনী বিশ্লেষণ: দিঘি পেরিয়ে সাগরের পথে

পশ্চিমবঙ্গের (West Bengal) ২০০৬ বিধানসভা নির্বাচন (elections) শেষে বামেরা ২৩৫ এবং তৃণমূল ও কংগ্রেস মিলিয়ে বাকি আসনগুলো জিতেছিল।

Adhiranjan Chowdhury, Abhishek Banerjee

🖋️ পার্থ প্রতিম বিশ্বাস: পশ্চিমবঙ্গের (West Bengal) ২০০৬ বিধানসভা নির্বাচন (elections) শেষে বামেরা ২৩৫ এবং তৃণমূল ও কংগ্রেস মিলিয়ে বাকি আসনগুলো জিতেছিল। তারপর সেদিনের বাম মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবু বাঁকুড়ার এক সভায় বলেছিলেন আমরা ২৩৫ আর ওরা ৩০। আরও অনেক ভয় ধরানো কথা সেদিন তিনি বলেছিলেন।

মাত্র ২ বছর পর ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল ২টো এবং কংগ্রেস ২টো জেলাপরিষদ সহ অসংখ্য জেলায় অধিকাংশ পঞ্চায়েত সমিতি ও স্থানীয় পঞ্চায়েতগুলোয় ক্ষমতায় এসেছিলো। তারপর ২০০৯ এর লোকসভা নির্বাচনে এ বাংলার ৪২ টি আসনের ভেতরে ২৭ টি আসনে জয়ী হয়েছিলো তৃণমূল + এসইউসিআই জোট ও জাতীয় কংগ্রেস। ২০১০ সালের পুরসভা ভোটে বামেরা আশি শতাংশ জায়গায় হেরেছিল। সব শেষে ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচন। ১২ ই মে তারিখ বিকালে সাংবাদিক সম্মেলনে বামফ্রন্ট এর চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেছিলেন, আমরা ২০০ আসনে জিতবো। উন্নততর অষ্টম বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হবে। ফলাফল হয়েছিলো উল্টো। বামেরা মাত্র ৬২ আসন পেয়ে হারিয়ে ছিলো তাদের টানা ৩৪ বছরের ক্ষমতা।

   

ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে। ইতিহাস শিক্ষা দেয়। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করেনা। তৃণমূল গঠনের পর থেকে অন্তত তিনবার মমতা ব্যানার্জী বিজেপির সাথে সরাসরি জোট করেছেন। ২০১১ সালে জাতীয় কংগ্রেসের সাথে জোট করে সরকার গঠনের পরের বছরই সেই জোট ভেঙে বেইমানি করেছেন। সেই সময়ের প্রদেশ সভাপতি মানস ভুইঞার তখনকার বক্তব্যগুলো পারলে ইউটিউবে দেখে নেবেন। মমতা ব্যানার্জী কিভাবে জাতীয় কংগ্রেসের সাথে বেইমানি করেছিলেন তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা মানস ভুইঞাই বলেছিলেন সাংবাদিকদের।

ক্ষমতায় থাকার জন্য মমতা ব্যানার্জীর কাছে দশ বছর সময় ছিল। জাতীয় কংগ্রেসকে শেষ করতে বিজেপি NRC CAA ইত্যাদি কালাকানুন এনে এবং আরও নানান কায়দায় তৃণমূলকে ২০২১ সালে জয়ী হতে সাহায্য করে। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে স্বাধীনতার পর থেকে এ বাংলায় প্রতিষ্ঠিত দল জাতীয় কংগ্রেস ও বামেরা শূন্য হয়ে যায়। বিজেপির সাহায্য নিয়ে মমতা ব্যানার্জী এই দুটো দলকে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় শূন্য করতে পারলেও মানুষের মন থেকে মুছে দিতে পারেননি। শূন্য করতে পারলেও তার আকাশছোঁয়া দুর্নীতির সাথে যুক্ত করতে পারেননি। তৃণমূলে একটাই পোষ্ট বাকী সব ল্যাম্পপোষ্ট হলেও অন্য দলগুলোতে ওরকম দলে দলে ল্যাম্পপোষ্ট নেই। সেখানে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো মানুষ যেমন আছেন তেমনি নতুন নতুন নেতৃত্ব তৈরীও হচ্ছেন। গত প্রায় বারো বছরে তৃণমূল কলেজগুলোতে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে দিয়েছে। নতুন কোনো কলকারখানা হয়নি ফলে শ্রমিক সংগঠনগুলোও বিস্তার লাভ করেনি।

চরম বেকারত্বের কারণে সামান্য রোজগারের জন্য দলেদলে যুবকরা পরিযায়ী হওয়ায় যুবদের ভেতরেও সংগঠন গড়ে ওঠেনি। তাছাড়াও কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন দমন-পীড়ন নীতি, শিক্ষার অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া, চাকরি পাওয়ার সুযোগ সংকুচিত করা ও লাগাতার মূল্য বৃদ্ধির ফলে দিশাহারা মানুষ দ্রুত নিজেদের সংগঠিত করতে পারেননি। কোলকাতা ফুটবলে মোহনবাগান ও ভাতৃসংঘের ভেতরে খেলা হলে যেমন আগেই বলা যেতো কোন দল জিতবে, তেমনিই ক্ষমতায় থাকার দৌলতে ও পুলিশ প্রশাসন ব্যাবহার করে তৃণমূল বারবারই জিতে গিয়েছে। ওরা জিতেছে আর মনে করেছে এটা তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি। তাই মানুষের দাবীকে সম্মান না দিয়ে তারা চিটফান্ড থেকে চাকরি চুরি, সিন্ডিকেট তোলাবাজি দাদাগিরি মস্তানি এমনকি বিরোধী দলের কেউ জয়ী হলে তাকেও চাপ দিয়ে বেআইনি ভাবে নিজেদের ঘরে আটকে রেখেছে।

মজার বিচার হলো, সাধারণ মানুষের চোখ সদা সজাগ ছিলো। তৃনমূল যেমন সে চোখ এড়াতে পারেনি তেমনি সাধারণ মানুষের মন বুঝতে বা পড়তে পারেনি। পৃথিবীর ইতিহাস বলছে, কেউ একছত্র ক্ষমতা পেলে এরকমই হয়। হিটলার থেকে মুসোলনী, ইদি আমিন থেকে পাকিস্তানি সামরিক শাসক, জোর করে ক্ষমতা দখল করে কেউ কোথাও তা বেশিদিন ভোগ করতে পারেনি। মমতা ব্যানার্জী বা নরেন্দ্র মোদী মোটেও মঙ্গলগ্রহের মানুষ বা ব্যাতিক্রম নন। যুগে যুগে ইতিহাস মানুষকে শিক্ষা দিয়েছে, পথ দেখিয়েছে। বিপথগামীকে ইতিহাস কোনোদিনও ক্ষমা করেনি, কোনদিন করবেও’না। দেওয়াল লিখন পড়তে পারলে ভালো, না হলে একদিন নিজেদেরই ওই দেওয়াল ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। এত অত্যাচার এত অনাচার এত মিথ্যা কপটতা কখনোই মানুষ সহ্য করতে পারে না। অত্যাচারিত মানুষের অভিশাপ, দীর্ঘশ্বাস কখনোই ভালোকিছু ডেকে আনে না। বরং ধ্বংশে পথে এগিয়ে নিয়ে যায়।

বাংলার মানুষ অপেক্ষায় আছে আরও একটা ধ্বংস দেখার। সাগরদীঘির বায়রন বিশ্বাস একটা বিন্দু মাত্র। এ বাংলার অত্যাচারিত নিপিড়ীত মানুষের মনের জোট ইতিমধ্যেই হয়ে গিয়েছে। তারা যেখানেই সুযোগ পাবেন সেখানেই রুখে দাঁড়াবেন। যার ফলাফল হবে একটাই, সাম্প্রদায়িক শক্তি ও অত্যাচারী শাসকের চিরবিদায়।
(প্রতিবেদনের সমস্ত বক্তব্য লেখকের নিজস্ব মতামত৷ এই মন্তব্যের দায়ভার প্রতিবেদকের)