Pataliputra: জ্যোতি বসুকে টার্গেট করে গুলি চালালো সুপারি কিলার, একজন পড়ে গেল

প্রসেনজিৎ চৌধুরী: একটু এদিক ওদিক হলেই ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে মারাত্মক ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল। কী হতে পারত তা ভেবে নেবেন ঘটনাটা জানলে। বিহার ভিত্তিক যে রাজনৈতিক…

প্রসেনজিৎ চৌধুরী:
একটু এদিক ওদিক হলেই ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে মারাত্মক ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল। কী হতে পারত তা ভেবে নেবেন ঘটনাটা জানলে। বিহার ভিত্তিক যে রাজনৈতিক হত্যা-গণহত্যার পর্বগুলি সংঘটিত হয়েছিল তার শুরুটা ছিল জ্যোতি বসুকে খুনের সুপারি নিয়েই। সেটা আবার ঘটে পাটলিপুত্র (Pataliputra) নগরেই।

জরুরি অবস্থার দুঃস্বপ্ন তখনও আসেনি। জেপি (জয়প্রকাশ নারায়ণ) স্বমহিমায় পাটনায় বিরাজ করছেন। গান্ধীবাদী দর্শনের তত্ত্বে তাঁর নিরস্ত্র আন্দোলনের তীব্র স্রোত যেমন ছিল তেমনই গয়ার ফল্গু নদীর মতো অন্তঃসলিলা ধারায় বইছিল বোমা-গুলি।

পাটনা
৩১ মার্চ, ১৯৭০
পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলনেতা ও সিপিআইএম শীর্ষ নেতা জ্যোতি বসুকে খুনের ছক করা হয়। তাঁকে লক্ষ্য করে আততায়ী গুলি চালাল।আত্মজীবনী ‘যত দূর মনে পড়ে’ বইতে সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন তিনি- ” প্রবল শ্লোগানের মধ্যে হেঁটে এসে স্টেশনের বাইরে সবে দাঁড়িয়েছি। হঠাৎ ফুট দশেক দূরে বাঁদিক থেকে এক ঝলক আগুনের হলকা দেখি। মুহূর্তেই মনে হলো কি যেন একটা তীরবেগে আমার হাতের আঙুল ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল। কিছু বুঝবার আগেই একটা আর্তনাদ। দেখি আমার একটু পেছনে একজনের জামা রক্তে লাল হয়ে গেছে। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে পড়েছিলাম। সেই রক্তাপ্লুত ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।  পরমুহূর্তেই ঘোর কাটল প্রচণ্ড চিৎকারের মধ্যে। চারিদিকে তখন ‘ধর্ ধর্’ আওয়াজ। কিন্তু ঐ প্রবল ভিড়ের মধ্যে আততায়ী তখন মিলিয়ে গেছে। জানলাম গুলিবিদ্ধ ব্যক্তির নাম আলি ইমাম। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়।”

পাটনা স্টেশনের কাছে জ্যোতি বসুকে হত্যা চেষ্টার এই ঘটনা বিহারের রাজনৈতিক সালতামামিতে স্থান পেয়েছে। সব শুনে খোদ জেপি হতবাক হয়ে যান। পরবর্তী সময়ে জরুরি অবস্থায় আন্দোলন যাতে হিংসাত্মক না হয় সেই দিকে তাঁর কড়া নজর ছিল। গান্ধীবাদী জয়প্রকাশ নারায়ণ শর্ত বেঁধে দিয়েছিলেন, অস্ত্র হিংসা ছাড়ো তবে আমি আছি। প্রবল ব্যক্তিত্বের সামনে আর কারোর কিছু বলার ছিল না।

বিহারের মসনদ লড়াইয়ের কুশীলবদের  লক্ষ্য করলে দেখবেন বর্ণ হিন্দু, উচ্চবংশীয় মুসলিম, দলিত, অচ্ছুত সম্প্রদায়ে এনারা মিশে আছেন। এই জাতি বিভাজন বারে বারে নির্বাচনে ছক্কা মেরে নজির গড়েছে। জেপি যতই এদের এক করার চেষ্টা করেছেন অলক্ষে হেসেছে সামন্তবাদী রক্তচরিত্র। জেপি পরবর্তী বিহার এই জাতিবাদকে ভিত্তি করেই বারবার রক্তাক্ত ঘটনার কাহিনি লিখেছে। হামলা, প্রত্যাঘাত, গণহত্যা, জাতিগত সংঘর্ষ, জমির লড়াই, বর্ণবাদ ভিত্তিক শোষণ বনাম গণতান্ত্রিক লড়াই-সবমিলে বিহার অদ্বিতীয় একটি রাজ্য। যেখানে নিয়ম না মানা হলো দস্তুর।

এই বিহার ক্রমে জেপি-কে ভুলছিল। দ্রুত ক্ষমতার অলিন্দে চলে আসছিলেন লালুপ্রসাদ যাদব, নীতীশ কুমার, রামবিলাস পাসোয়ান, শিবু সোরেনের মতো নেতারা। পুরাতনী নেতাদের মধ্যে ছিলেন দুই মার্কসবাদী গণেশ শংকর বিদ্যার্থী, চতুরানন মিশ্র (পূর্বতন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী)। উঠে আসছিলেন জনসংঘী ও পরে বিজেপি নেতা সুশীল মোদী, সৈয়দ শাহনওয়াজ হুসেন, আরএসএসের অশ্বিনী চৌবে।

‘সত্তরের দশক মুক্তির দশক’ তীব্র রাজনৈতিক বিতর্কিত স্লোগান উঠেছিল পশ্চিমবঙ্গ থেকে। সশস্ত্র কৃষি আন্দোলন ভিত্তিক নকশালবাড়ি রাজনৈতিক তত্ত্বের সমর্থর রাজনৈতিক সংগঠনগুলি পরবর্তী সময়ে নিজেদের জমি খুঁজে নেয় বিহারেই। কারণ, পশ্চিমবঙ্গে তাদের রাজনীতি থমকে গেছিল এই সত্তর দশকেই। ১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পাটনায় অল্পের জন্য বেঁচে যাওয়া জ্যোতি বসু হয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী।  সাতাত্তর সাল পরবর্তী সময়ে পশ্চিমবঙ্গ রক্তাক্ত রাজনৈতিক আন্দোলন থেকে সরে এসেছিল। তার আগে ১৯৭০-১৯৭২ সালের প্রবল রাজনৈতিক ঘনঘটার সময়। পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে চলছিল ত্রিপাক্ষিক রাজনৈতিক সংঘর্ষ। তৎকালীন শাসক কংগ্রেস বনাম বিরোধী সিপিআইএম ও অতিবামপন্থী নকশালপন্থীদের পারস্পরিক সংঘর্ষ, রাজনৈতিক খুন, গণহত্যার এই সময়টি বিহারকেও লজ্জায় ফেলে দিতে পারে।

আশির দশকের বিহার এরপর মারাত্মক সব ঘটনার কেন্দ্রে আসবে। জ্যোতি বসুকে গুলি করে মারার চেষ্টা যেন ট্রেলার। বাকিটা গা কাঁপিয়ে দেয়া সিনেমার থেকেও ভয়ঙ্কর। (চলবে)

গত পর্ব: Pataliputra: জেপি দর্শন মুখ থুবড়ে পড়তেই রক্তাক্ত রাজনীতি শুরু