Pataliputra: জেপি দর্শন মুখ থুবড়ে পড়তেই রক্তাক্ত রাজনীতি শুরু

প্রসেনজিৎ চৌধুরী রণভূমি বিহার। এই রণক্ষেত্রের সীমানা উত্তরে নেপাল, পশ্চিম দিকে উত্তর প্রদেশ, দক্ষিণ-পূর্বে এখনকার ঝাড়খণ্ড, পূর্ব দিকে বঙ্গাল-পশ্চিমবঙ্গ। রণভূমি বলছি এই কারণে যে স্বাধীনতার…

patliputra

প্রসেনজিৎ চৌধুরী
রণভূমি বিহার। এই রণক্ষেত্রের সীমানা উত্তরে নেপাল, পশ্চিম দিকে উত্তর প্রদেশ, দক্ষিণ-পূর্বে এখনকার ঝাড়খণ্ড, পূর্ব দিকে বঙ্গাল-পশ্চিমবঙ্গ। রণভূমি বলছি এই কারণে যে স্বাধীনতার আগে থেকে জাত ভিত্তিক অত্যাচার চলে আসছে বিহারে, তার বিরুদ্ধে সর্বাধিক প্রতিরোধে ‘কাট্টা’ হয়েছিল মূল হাতিয়ার। গত শতকের ৮০-৯০ দশক জুড়ে পরপর গণহত্যা, তার বদলায় ফের গণহত্যায় রক্তাক্ত চেহারা নিয়েছিল এই রাজ্যটি।

এখানে হাতে হাতে কাট্টা ঘোরে। সরু পাইপ দিয়ে স্প্রিংয়ের ট্রিগার। একবারে একটা বুলেট। ট্রিগার টিপলেই গুলি চলে। লাস পড়ে। প্রতিপক্ষ বন্দুক নিয়ে তেড়ে আসে। আবার গুলির ঝড়। কাট্টা-বন্দুকের ধুঁয়াধার লড়াই শেষে পড়ে থাকে আরও কতগুলো লাস। এই লড়াইয়ের মাঝে রাজনৈতিক তত্ত্ব ছড়ায়। সামন্তবাদ বনাম সমাজবাদ সংঘর্ষের অন্তরালে কূটিল হাসে রক্তচরিত্র দানব। আসব সে কথায়। এর আগে প্রেক্ষাপট বলতে হবে।

যে রক্তাক্ত বিহারের কথা লিখছি। এই ভূমি আবার বুদ্ধ-গান্ধীবাদের মূল ক্ষেত্র! অহিংস দর্শনের আধারগৃহ। এর ব্যাপ্তি বিশাল। সেই অহিংস মহাসাগরের তীরে এসে বারবার নিজেকে ভেঙেছিলেন স্বাধীন ভারতের কংগ্রেস বিরোধী ‘গান্ধী’। জীবনভর সংঘর্ষ। উল্কার গতিতে  রাজনৈতিক আন্দেলনে ঝাঁপিয়ে পড়া, মুহূর্তে বিলীন হয়ে যাওয়া। এই আঙ্গিকে বিচার করলে গান্ধী পরবর্তী ভারত যে আ-সমুদ্র হিমাচল গ্রহণযোগ্য নেতাকে পেয়েছিল তিনি বিহারিবাবু-জয়প্রকাশ নারায়ণ-জেপি।

বিহারি জেপি’র বজ্রকণ্ঠস্বর নড়িয়ে দিয়েছিল স্বাধীন ভারতের জবরদস্ত কংগ্রেসি ইমারতের ভিত। তাও কোন সময়, যখন ক্ষমতায় ‘প্রিয়দর্শিনী’ ইন্দিরা।  ১৯৭১ সালের যুদ্ধে পাকিস্তানকে নাস্তানাবুদ করার কূটনৈতিক বুদ্ধিমত্তার সফল প্রয়োগকারী। বাংলাদেশের জন্ম ও ‘এশিয়ার মুক্তিসূর্য’ উদয় একই সময়ের ঘটনা। তবে ‘মুক্তিসূর্য’ ইন্দিরা গান্ধীর বজ্র আঁটুনিকে আলগা করেছিলেন সর্বজনশ্রদ্ধেয় জয়প্রকাশ নারায়ণ। তিনি মহাত্মা গান্ধীর শিষ্য-সমাজতান্ত্রিক নেতা।

বিহার রাজনীতিতে যে রাজনৈতিক রণকুশলী সেনাপতিরা আছেন। তাঁরা এখন বয়স্ক। এরা বিভিন্ন শিবিরের অধিনায়ক। প্রত্যেকেই জেপি’র শিষ্য। তালিকায় তারকা নাম নীতীশ কুমার, সুশীল কুমার মোদী, পূর্বতন মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব, রামবিলাস পাসোয়ান (প্রয়াত) ও প্রতিবেশী রাজ্য ঝাড়খণ্ডের অন্যতম জন্মদাতা শিবু সোরেন। এখন এদের সবার দলীয় পতাকা আলাদা। এরা জেপি’র দেখানো গান্ধী আদর্শের পথ ছেড়ে এসেছেন। দুর্নীতির রঙে হাত ধুয়েছেন অনেকেই। আবার সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইও করেছেন। সব মিলেমিশে গেছে। আর জেপি এখন শুধুই ছায়ামানুষ। পাটনা হোক বা রাঁচি কিংবা ধরুন দিল্লিতে যখন এই প্রাক্তনী জেপি শিষ্যরা এক হন, তখন ক্ষণিকের জন্য তাঁদের মনে ঝিলিক মারে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে বিরাট জমায়েত আর ১৮ মার্চের দিনটা।

১৯৭৪ সালের ১৮ মার্চ,  ‘লোহুলুহান’ হয়েছিল বিহারের রাজধানী। সরকার জারি করবে ‘কালা কানুন’ এই গুঞ্জন প্রতিবাদের বিরাট ঢেউ হয়ে গঙ্গা তীরের পাটনা থেকে ক্ষীণ যমুনার ধারে দিল্লিতে কাঁপন ধরায়।প্রতিবাদী ভারতের সে এক অভিনব মুহূর্ত। সরকারে কংগ্রেস। বিরোধীপক্ষ জেপি- কিন্তু কোনো দল নেই। সমাজবাদী, কমিউনিস্ট, জনসংঘী, আরএসএস সব এক হয়েছিল তাঁর ছায়াতলে। সবাই চায় প্রতিশোধ।জেপি বললেন, আপনারা হিংসাত্মক আন্দোলনের পথ ছাড়ুন। আমি আছি। ১৯৪৮ সালে সংঘ ঘনিষ্ঠ গডসের গুলিতে খুন হওয়া মহাত্মা গান্ধী যেন ফিরে এলেন। সেই শুরু। গঠিত হলো বিহার সংঘর্ষ সমিতি-একটি মঞ্চ। আর জেপি তার সর্বাধিনায়ক। ভারত প্রস্তুত গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের জন্য।

” স্বাধীনতা তুমি …
বয়সী বটের ঝিলিমিলি পাতা “- শামসুর রহমান

স্বাধীনোত্তর ভারতে প্রথম হুঙ্কার দিল বিহার। দেশ নড়ে গেল। ১৯৭৪ সালের ভারত এমনই। এক বছর পরে ১৯৭৫ সালের ভারত জুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। বাক-স্বাধীনতা হরণ হলো। কিন্তু কণ্ঠ স্তব্ধ কই হলো? রাজনীতির উদভ্রান্ত উল্কা জেপি শুরু করলেন প্রতি আক্রমণ-তাঁর বাপুর দেখানো পথে।

উদভ্রান্ত উল্কা জেপি

জয়প্রকাশ নারায়ণ যিনি গান্ধীর শিষ্য হয়েও গান্ধী সমালোচক-আগ্রাসী। বিয়াল্লিশের ভারতে জেলভাঙা, রেল-লাইন উপড়ে ফেলা ও হাতাহাতি সংঘর্ষের কুশলী নায়ক। আবার মার্কসবাদী দর্শনে পুষ্ট হয়ে গান্ধী মতের বিরুদ্ধেই অহিংসা আন্দোলনের দার্শনিক। এমন মানুষের জীবনভর দ্বন্দ্ব। দোদুল্যমান জীবন। আজীবন বিহারি। সংগ্রামের তত্ত্ব নিয়ে কাটাছেঁড়া করা গবেষক। তাঁর পথেই বিহার দেখিয়েছিল ভারতের গণজাগরণ। জরুরি অবস্থার প্রতিবাদে সেই গণআন্দোলনের ধাক্কায় ১৯৭৭ সালে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেসের সরকার পড়ে যায়। বাঁক নেয় ভারতের ইতিহাস। ভারতের শাসক হয় প্রথম অ-কংগ্রেসি জনতা সরকার। এই তীব্র রাজনৈতিক জোয়ারের মাঝে উল্কার মতো মিলিয়ে গেলেন জেপি। কে ধরবে জনতার হাল? এই সুযোগে ফের কংগ্রেস ‘সত্তা হাসিল’ করে।  ইন্দিরাকে ধন্য ধন্য করে সেই কূটনৈতিক জয়ের মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে পড়ে মস্কো থেকে ওয়াশিংটন ভায়া লন্ডন, প্যারিস। গণ আন্দোলনের রাজনীতি আর ভোটের লড়াই এক বিষয় না, বহু পোড় খাওয়া জেপি হাড়ে হাড়ে টের পেলেন।

জেপি যে গণ আন্দোলনের ভিত তৈরি করেছিলেন তাতে সামন্তবাদ থমকে গেছিল। জেপির বিরাট ব্যক্তিত্বের সামনে দলিত-ব্রাহ্মণ- ক্ষত্রিয় আর মুসলমান সমাজের সরাসরি রাজনৈতিক সংযোগ হয়। তবে জেপিরঅস্থির রাজনৈতিক অবস্থানে কী ঘটতে চলেছে তা আন্দাজ করেছিল কংগ্রেস। তাঁকে সাইড লাইনে সরাতে বেশি কিছু করতে হবে না। কারণ জাতি সমন্বয় দীর্ঘস্থায়ী হয়না সেটা কংগ্রেসের ক্রাইসিস ম্যানেজাররা বিলক্ষণ জানতেন। তাঁরা সঠিক ছিলেন। দিল্লিতে অবধারিতভাবে জনতা সরকারের পতন হয়। জেপির অহিংস গণআন্দোলনের রাজনীতি ফের জাতি ভিত্তিক ঘূর্ণাবাত্যায় স্বমূর্তি ধারণ করে। বিহারের মসনদ ঘিরে তখন মায়ামৃগ চরে বেড়াচ্ছে। ধরতে গেলেই ফস্কে যায়। জনতা পার্টি ঘাড় গুঁজে বসতেই তার ঘাড়ে চেপে মসনদের উপর বসল কংগ্রেস। উনিশশো পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে জেপি দর্শন মুখ থুবড়ে পড়তেই বিহারের মাটিতে রক্তাক্ত রাজনীতির শুরু।

বিহার বিধানসভা ভবনের অলিন্দে জয়প্রকাশ নারায়ণের তৈলচিত্রের ছায়া লম্বা হয়ে পড়ে থাকে। এই ছায়াটা পার করে নেতা মন্ত্রী সান্ত্রীরা যাতায়াত করেন। ছবিটার দিকে এক পলক তাকিয়ে থাকলে এদের বুকে ক্ষণিকের জন্য ঠাণ্ডা স্রোত বয়।

হাজার হোক ছবিটা জেপি সাহাবের- ‘উও আদমি নেহি অবতার থে!’                                            (চলবে)

গত পর্ব: Pataliputra: রক্তচরিত্রের জীবাণু হু হু করে ছড়ায়, ভয়াবহ সেই রূপ