Pataliputra: বিদ্রোহী বিহারে কুঁয়র সিংয়ের হামলায় পরাজিত হয় ব্রিটিশ, জনজাগরণে জয়ী হন জেপি

প্রসেনজিৎ চৌধুরী: বিহারের রাজধানী পাটনা হলো মহাবিদ্রোহের (১৮৫৭) অনুচ্চারিত কেন্দ্র। এই বিরাট বিদ্রোহে অর্ধেক ভারত জেগেছিল। বিদ্রোহের কেন্দ্র “মুঘল সলতনত্” দিল্লি হতে পারে, লখনউ হতে…

প্রসেনজিৎ চৌধুরী:

বিহারের রাজধানী পাটনা হলো মহাবিদ্রোহের (১৮৫৭) অনুচ্চারিত কেন্দ্র। এই বিরাট বিদ্রোহে অর্ধেক ভারত জেগেছিল। বিদ্রোহের কেন্দ্র “মুঘল সলতনত্” দিল্লি হতে পারে, লখনউ হতে পারে, কানপুর, ফৈজাবাদ, মীরাট, ব্যারাকপুর, রামপুর, ঝাঁসি, গোয়ালিয়র হতেই পারে। পাটনা কিন্তু প্রায় ব্রাত্য। অথচ পাটনা ঘিরে একের পর এক বিদ্রোহী সিপাহীদের হামলা হয়েছে। গঙ্গা তীরে বিহারে এই রক্তগাথা লেখা আছে। অন্যত্র তাবড় তাবড় বিদ্রোহীদের দুরন্ত যুদ্ধ, সর্বশেষে পরাজয় সবই ভারতের স্বাধীনতার লড়াইয়ের গৌরব। তবে বিহার আলাদা। কারণ, বিহারের মাটিতে বিদ্রোহীদের সঙ্গে  বিজয় জড়িয়ে আছে। আসুন বিহারে। শুনতে পাবেন (Pataliputra)

পরাধীন ভারতে  বৃহত্তম বিদ্রোহ হয়েছিল ১৮৫৭ সালে।আর স্বাধীন ভারতের সর্ববৃহৎ গণবিদ্রোহ হয় ১৯৭৫ সালে। দুটি বিদ্রোহে-ই বিহার জয়ী। এই দুটি ঘটনা ভারত কথার মোড় ঘুরিয়েছে।

রক্তে লাল হয়েছিল সেদিন। ব্রিটিশ পতাকা নামিয়ে দিয়ে শেষ জয়টা হাসিল করলেন বাবু কুঁয়র সিং (কানোয়ার সিং) ও তার সেনাবাহিনী। ১৮৫৮ সালের ২৩ এপ্রিল বিহারের মাটিতে সেই একবার এবং শেষবারের মতো মহাবিদ্রোহ (সিপাহী বিদ্রোহ) সবথেকে বড় সফলতা পেল জগদীশপুরে। জয়ী জমিদার বাবু কুঁয়র সিং।

সিপাহী বিদ্রোহ বা মহাবিদ্রোহের সর্বাধিনায়ক মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর (২য়) সবথেকে প্রবীণ ব্যক্তি ছিলেন। আর লড়াইয়ের মাঠে জগদীশপুরের জমিদার কুঁয়র সিং ছিলেন দ্বিতীয় প্রবীণ ব্যক্তি ও সেনপাতি।  কুশলী এই যোদ্ধা শেষ লড়াইয়ে জগদীশপুরকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন থেকে মুক্ত করেন। ব্রিটিশরা পরাজয় মেনে নেয়। জগদীশপুরে নামিয়ে দেওয়া হয় ব্রিটিশ পতাকা। যুদ্ধে আহত কুঁয়র সিং তিনদিন পর ২৬ এপ্রিল প্রয়াত হন। মহাবিদ্রোহের সবথেকে উল্লেখযোগ্য জয়ের কেন্দ্র ছিল জগদীশপুর।

বীর কুঁয়র সিং এক জমিদার। তাঁর লড়াই গাথা হয়ে গ্রামে গ্রামে চারণ কবিদের কণ্ঠে ছড়িয়ে আছে। ইতিহাসের পাতায় ধরা আছে তথ্য সমাহারে। ব্রিটিশদের প্রচারিত ‘সিপাহী বিদ্রোহ’কে ‘ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম’ বলে চিহ্নিত করেন জার্মান অর্থনীতিবিদ কার্ল মার্কস। সেই বিখ্যাত সংগ্রামে জয়ী এক সামন্ত জমিদার কুঁয়র সিং। মার্কসের দৃষ্টিতে দ্বন্দ্ব এখানেই। বিদ্রোহী বিহার এই দ্বন্দ্ব নিয়েই প্রায় দুই শতক পার করছে।

“याचना नहीं, अब रण होगा,
जीवन-जय या कि मरण होगा”-রামধারী সিং দিনকর

কবি দিনকরের আগুনে অক্ষর-ই যেন বিদ্রোহের ভবিষ্যৎ ঠিক করে দিয়েছে। হয় বিজয় নয় মৃত্যু এই তত্ত্বের এমন কাব্যিক প্রয়োগকারী রামধারী সিং দিনকরের ফুলে ঢাকা বিশাল ভাষ্কর্য বেগুসরাইয়ের গৌরব। 

বেগুসরাই নামে চমকে গেলেন? এই সেই জায়গা যেটি মানি-মাসল-মার্কসবাদের ত্রিমাত্রিক রণভূমি। বারবার রক্তাক্ত হয়েছে। রাজনৈতিক ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্র। কবি দিনকর দেশীয় সামন্তবাদের প্রবল বিরোধিতা করে কলমে আগুন ছড়িয়েছিলেন। আজও তাঁর লেখা সামন্তবাদের বিরুদ্ধে বৌদ্ধিক প্রাচীর। দিনকর মহাবিদ্রোহ পরবর্তী ভারতের অন্যতম সমাজ বিশ্লেষক।

মহাবিদ্রোহে বিহার থেকে জয় এসেছিল। আসলে বিহার মানেই আপোষহীন সংঘর্ষের ভূমি। সেই ভূমির ফসল জয়প্রকাশ নারায়ণ। স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সাল ছিল আরো এক মহাবিদ্রোহ-গণজাগরণের বছর।  জরুরি অবস্থা জারির পরেই পাটনা হয়েছিল ভারতের বিদ্রোহ রাজধানী। বিখ্যাত বিহার সংঘর্ষ সমিতির গর্ভগৃহ। রাস্তায় রাস্তায় লড়াই চলেছে। তীব্র রাজনৈতিক কালবৈশাখীর দাপটে তখন কাঁপতে শুরু করেছে আসমুদ্র হিমাচল। পাটনার গান্ধী ময়দান থেকে বৃদ্ধ জেপির হুঙ্কারে দিল্লিওয়ালারা দিনে অমাবস্যার আঁধার দেখছিলেন।

পাটনা সব সময়ের কুচক্রী রাজনীতির আখড়া। আবার বিদ্রোহের লাল আগুনে ছায়ামানুষ হয়ে থাকেন সামন্ত জমিদার কুঁয়র সিং থেকে সমাজবাদী নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ। দু’জনেই দুই শতাব্দীর দুই নায়ক।

বৌদ্ধ যুগে ভারতে ১৬টি মহাজনপদের মধ্যে  প্রজাতন্ত্রের পতাকা উড়িয়েছিল দু’টি, আর ১৪টি রাজতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করেছিল। সেই সুপ্রাচীন দুই প্রজাতান্ত্রিক জনপদ হল বৃজি ও মল্ল। আজকের বিহারের মাটিতেই তাদের ভৌগোলিক অবস্থান। তবে তারা টিকতে পারেনি। কারণ  মগধ, কোশল, অবন্তী ও বৎস নামের চারটি প্রবল শক্তিশালী রাজতন্ত্রের দাপট।গঙ্গা নদীর উত্তর এলাকা এবং নেপালের নিম্নবর্তী এলাকার মাঝে যে প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় কাঠামো তৈরি হয়েছিল, তা-ই বিশ্বের সুপ্রাচীন। যদিও এই ধরণের শাসন ব্যবস্থার কিছু নিদর্শন মেলে ইউরোপে। লড়াইটা রাজা বনাম প্রজা। সেই লড়াই ক্রমে আধুনিক ভারতে ছড়িয়েছে এই বিহার থেকেই। এখানে রাজা জমিদার ভূমিহার বনাম কৃষক খেতমজুর শ্রমিকের সংঘর্ষ হল সমকালীন রূপ। উঁচু জাত আর নিচু জাতের লড়াই।

যে প্রজাতন্ত্রের পীঠস্থান হিসেবে বিহারভূমি গর্ব করে তা জয়প্রকাশ পরবর্তী ৮০-৯০ দশকে কিন্তু প্রবল রক্তাক্ত। একুশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত এর ব্যাপ্তি। ভূমি মালিকের সঙ্গে দলিত ও ক্ষেতমজুর সংঘর্ষ। বিহার এমনই।

গরম লিট্টির চুল্লি আর রুটির ঝলসানো তাওয়ায় যেখানে জীবন ছন্দ ঘোরে সেই বিহারের মাটিতে পড়ে থাকে খেতমজুর-ভূমিহীনের সারি সারি লাশ। রক্তে ভেসে যায় গ্রামের পথ। সন্ধে নামলে নদী তীরে জ্বলে ওঠে সারি সারি চিতা।

কান্না অস্পষ্টস্বরে জানিয়ে দেয় ‘বদলা লেঙ্গে’ (চলবে)

গত পর্ব: Pataliputra: পিস্তল নাচিয়ে গান্ধীবাদী হাইজ্যাকার কৈরালার হুমকি, বিহারের মাঠে বিশ্ব কাঁপল