Pataliputra: খাপরার চালের ঘরে থাকা মার্কসবাদী এ কে রায়ের মৃদু হাসিতে বুক কাঁপত কয়লা মাফিয়াদের

প্রসেনজিৎ চৌধুরী: জাতিবাদ ভিত্তিক গণহত্যার একের পর এক ঘটনায় শিহরণ যেমন ছড়াচ্ছিল, তেমনই ধিকিধিকি আগুন জ্বলছিল অন্য খাতে। এই আগুনের আঁচে তেতে উঠছিল বিহার ভাগের…

প্রসেনজিৎ চৌধুরী:
জাতিবাদ ভিত্তিক গণহত্যার একের পর এক ঘটনায় শিহরণ যেমন ছড়াচ্ছিল, তেমনই ধিকিধিকি আগুন জ্বলছিল অন্য খাতে। এই আগুনের আঁচে তেতে উঠছিল বিহার ভাগের দাবি অর্থাৎ ঝাড়খণ্ড আন্দোলন। দেওঘরের কড়াপাকের পেঁড়ার মতো জমাট হচ্ছিল ভাঙন রাজনীতি। এখন যে হিন্দিভাষী ঝাড়খণ্ড রাজ্য, সেটি তৈরির ক্ষেত্রে এক বঙ্গভাষীর অবদান রয়েছে। আধুনিক পাটলিপুত্রের (Pataliputra) রাজনীতির কিংবদন্তি এই ব্যক্তিত্বের জীবন বলিউডের জমজমাট সিনেমা বা ওয়েব সিরিজ তৈরির খনি। ইনি এ কে রায়। নাম ই কাফি হ্যায় !

গত শতকের পঞ্চাশের দশকে ‘বঙ্গ বিহার সংযুক্তি’ পদক্ষেপে কংগ্রেসের মুখ পুড়িয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় ও বিহারের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীকৃষ্ণ সিং। এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তীব্র বাংলা ভাষা ভিত্তিক আন্দোলনে কংগ্রেসের বড় ক্ষতি হয়। বিরাট মানভূম অঞ্চল কেটে জন্ম নেয় পুরুলিয়া। ভাষার ভিত্তিতে ভারতে তৈরি প্রথম জেলা। সেই মানভূম ভাষা আন্দোলনের ধাক্কায় নবগঠিত পুরুলিয়া থেকে কংগ্রেস মুছে গিয়েছিল।

   

ইতিহাস চাকার মতো ঘোরে। বিহারের অংশে পড়া মানভূমকে নিয়ে রাজ্য ভেঙে দেওয়ার দাবি জোরালো হচ্ছিল। নতুন এলাকার নাম ঝাড়খণ্ড হবে এমন দাবিতে আন্দোলন পাটনার রাজনৈতিক অন্দরমহলকে গরম করতে থাকে।  বনজ, কয়লা ও শিল্পাঞ্চলে বিশ্বশ্রেষ্ঠ দক্ষিণ বিহারের বিস্তির্ণ এলাকার কালো ধোঁয়া পাটনার রাজনীতিকে ঢেকে নিচ্ছিল।

এই ঝাড়খণ্ড  আন্দোলনের তিন ব্যক্তিত্ব শিবু সোরেন, এ কে রায় ও বিনোদ বিহারি মাহাতো।  ঝাড়খন্ড হোক বা বিহার এ কে রায় (অরুণ কুমার রায়)  দুই রাজ্যের রাজনীতিতে ‘লাল তারা’ হয়ে আছেন। তাঁকে খুন করতে গিয়ে কতবার কত মাফিয়া গুণ্ডা রিভলভার নামিয়ে নিয়েছে। অথচ রায়বাবু নির্বিকার। ‘বরিশাইল্যা বাঙাল’ অরুণ কুমার রায় কে ঘিরে ঘটনার ঘনঘটা।  যদিও  ভারতের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে হেভিওয়েট নেতা ও মুখ্যমন্ত্রীর তকমা রয়েছে ঝাড়খণ্ড আন্দোলনের অপর নেতা শিবু সোরেনের। কিন্তু তিনি নেহাতই একজন কুশলী জোট রাজনীতিক। একটা রাজ্যের জন্মদাতা কিংবদন্তি এ কে রায়ের টালির ঘরের সামনে শিবু সোরেনের সুযোগসন্ধানী রাজনীতি নতজানু হয় বারবার।

তখনও বিহার ভাগ হয়নি। পাক্কা বিহারি স্টাইলের চটকদারি রাজনীতি করা শিবু সোরেনের ঘাঁটি দুমকা। আর বিহারি বাহুবলী রাজনীতির কাছে মৃদু হাসির এ কে রায় মানেই ভয়। ধানবাদ রায়বাবুর ঘাঁটি।

ধানবাদের ধুলোয় বিহারি বাহুবলী রাজনীতির যে সব ওয়েব সিরিজ বা সিনেমা দেখেছেন, বিশ্বাস করুন বা নাই করুন সেসব  বাস্তবের ধারে পাশে যেতে পারে না।  তবু ভয়ঙ্কর বিভিন্ন মুহূর্ত গল্প হয়ে স্থান করে নেয় সেলুলয়েডে। ভারতের তথা বিশ্বের অন্যতম খনি অঞ্চলের অন্দরে বাহুবলী রাজনীতি  ছড়িয়ে আছে।

এমনই ধানবাদ। নুনডি কেলিয়ারি এলাকার কয়লার ধোঁয়া মাখা, ঘেয়ো কুকুরের কামড়াকামড়ি, নালার জল উপচে পড়ে মাছি ভনভন করা গলি মানেই খিস্তি আর অনর্গল হৈ হট্টোগোলে ভরপুর।  এই গলির খাপরার চালের ঘর থেকে সংসদ ভবন, পাটনার বিধানসভা কক্ষ বারবার ঘুরে আসা অরুণ কুমার রায় একজন মার্কসবাদী রাজনীতিক,  কমিউনিস্ট নেতা। ধানবাদের রায়বাবু।  তাঁকে অবশ্য পশ্চিমবঙ্গের বাম রাজনীতিকরা তেমন পাত্তা খুব একটা দেননি। পাজামা পাঞ্জাবি পরা লোকটা  আসানসোল, রানিগঞ্জে কিছুটা পরিচিত কিন্তু কলকাতার রাজপথ দিয়ে যখন হেঁটে যেতেন কেউ ফিরেও তাকাতেন না। অথচ তাঁকে দেখেই রিভলভার নামিয়ে নিত ভারত কাঁপানো কয়লা মাফিয়ারা।

“धुआँ उठा है कहीं आग जल रही होगी
असीर रौशनी बाहर निकल रही होगी”- গুলজার

ধানবাদের রাস্তায় বাহুবলী নেতাদের কাছে বিস্ময়-ইয়ে আদমি কো গোলিয়াঁ কাহে নেহি ছুঁ-তা ! ( এর দিকে গুলি করলে ফস্কায় কেন ?) কাকতালীয়ভাবে কয়েকবার হামলা হলেও বেঁচে যাওয়া রায়বাবুকে ঘিরে মিথ তৈরি হয় বৈকি। তবে সেই নুনডি কোলিয়ারির নোংরা গলির মধ্যে খাপরা চালের ঘরে ঢুকে তাঁকে মেরে যাওয়া যেমন সোজা আবার তেমনই কঠিন। কারণ, তেমন কিছু হলে গণরোষে হামলাকারীদের কেউই বাঁচবে না। এটাই আসল কথা। সাংসদ বিধায়ক নয় নিদেনপক্ষে পাড়ার কাউন্সিলর হয়ে বিপুল ঐশর্য্যের মালিক হওয়া যায় এ দেশে। আর এ কে রায় বারবার সংসদ ঘুরে এসে খাপরার চালা ঘরে থাকতেন।

মধ্য ও উত্তর বিহারের জাতিবাদের ভয়াবহ রক্তাক্ত হামলাও ম্লান হয়ে যায় ধানবাদ সিন্ধ্রির মাফিয়া চাঁইদের ভয়ঙ্কর হাসিতে। সেই হাসির বিনিময়ে হাল্কা হাসি ছিল এ কে  রায়ের। এহেন বরিশালের বাঙাল কী করে যে ঘাঘু শিবু সোরেনের সঙ্গে একই ঝাড়খন্ড আন্দোলনের শরিক ছিলেন সেটাই রহস্য।

সিপিআইএম যখন পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক জমি চষছিল সেই ‘৬০-‘৭০ দশকে লাল পতাকার চিহ্ন নিয়ে বিহার বিধানসভায় কয়লা মাফিয়া রাজের বিরুদ্ধে সরব হচ্ছিলেন এ কে রায়!  তবে বঙ্গ সিপিআইএমের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব ছিল কিছুটা। সেই দূরত্ব বাড়তে থাকে। সিপিআইএম ছাড়েন রায়বাবু। সেই থেকে ধানবাদে জমি হারায় সিপিআইএম। এ কে রায় সিপিআইএম ছাড়লেও মার্কসবাদ নীতি থেকে সরে আসেননি। নিজে দল তৈরি করেন।

অবিভক্ত বিহারের রাজনীতিতে দুটি এমসিসি দল। তার একটি ১৯৭১  সালে এ কে রায় তৈরি করেন। তাঁর তৈরি দলটির নাম মার্কসিস্ট কো-অর্ডিনেশন কমিটি (এমসিসি)। ভোটের লড়াইয়ে, শ্রমিক আন্দোলনে ও ঝাড়খণ্ড তৈরির দাবি নিয়ে সরব এই দল। ধানবাদের কয়লা মাখা রাজনীতিতে বিরাট প্রভাব ফেলেছিল এমসিসি। কমবেশি এখনও কিছুটা সেই প্রভাব আছে।

আর দ্বিতীয় এমসিসি ? এদের কথা তো আগেই বলেছি। বিহারের মাটিতে সামন্তবাদের বিরুদ্ধে বন্দুক তাক করা মাওয়েস্ট কমিউনিস্ট সেন্টার (এমসিসি) তৈরি হয় ১৯৭৫ সালে।  সামন্তবাদ কে রুখতে গিয়ে আজকের মাওবাদীদের এই পূর্বজরা বিভিন্ন নিম্নবর্গের জাতি গোষ্ঠীর বল-ভরসা ছিল। আবার জাতিবাদের চোরাগলিতে ঘুরে ভাড়াটে বাহিনীর ভূমিকা নিচ্ছিল। এদেরই পাল্টা সংগঠন উচ্চবর্ণের রক্ষাকারী সশস্ত্র রণবীর সেনা।

বিহারের রাজনীতিতে গণতন্ত্রী রায়বাবুর এমসিসি ও সশস্ত্র পথের এমসিসি এই দুটি  সংগঠন বারবার শিরোনামে এসেছে।

বিহার বিধানসভার ইতিহাস দেখলে একটা পরিসংখ্যানে নজর পড়বেই। এ কে রায় বিহারের প্রথম সিপিআইএম বিধায়ক ছিলেন এই রাজ্যের। ১৯৬৭ সাল থেকে পরপর তিনবার সিন্ধ্রি কেন্দ্র থেকে বিধায়ক হয়ে চমকের পর চমক তৈরি করেন তিনি। পরে  সিপিআইএম থেকে বেরিয়ে গেলেও কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের সিআইটিইউ (CITU) সঙ্গে রায়বাবুর ছিল অটুট যোগ৷ এটি সিপিআইএমের শ্রমিক সংগঠন। এ কে রায়ের দল এমসিসির শ্রমিক শাখা সিটুর অনুমোদন পায়৷ খনি-শ্রমিকদের শহর ধানবাদকে ভিত্তি করেই রায়বাবুর রাজনৈতিক জীবন ঘুরপাক খেতে থাকে৷

লড়াইটা হলো ধানবাদেই। রাজপুত বাহুবলী কংগ্রেস নেতা সূরজদেও সিংয়ের সঙ্গে বরিশাইল্যা বাঙাল একে রায়ের। (চলবে)

গত পর্ব: Pataliputra: ট্রিগারে আঙুল রেখে গাঁয়ে ঢুকল মাওপন্থীরা, মৃত্যুদণ্ড দিল রাজপুতদের