Pataliputra: ট্রিগারে আঙুল রেখে গাঁয়ে ঢুকল মাওপন্থীরা, মৃত্যুদণ্ড দিল রাজপুতদের

প্রসেনজিৎ চৌধুরী: সিপিআই (মাওবাদী) দলটি পশ্চিমবঙ্গে রক্তাক্ত পরিস্থিতি তৈরি করেছিল বামফ্রন্ট জমানায়। যে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের নাম এখনকার ‘মাওবাদী’ সশস্ত্র দলটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাদের পূর্বসূরীরা…

প্রসেনজিৎ চৌধুরী:
সিপিআই (মাওবাদী) দলটি পশ্চিমবঙ্গে রক্তাক্ত পরিস্থিতি তৈরি করেছিল বামফ্রন্ট জমানায়। যে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের নাম এখনকার ‘মাওবাদী’ সশস্ত্র দলটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাদের পূর্বসূরীরা কম কিছু না। এরা দাবি করেন ‘মাওবাদ’ একটি রাজনৈতিক তত্ত্ব। যদিও এমন কোনও তত্ত্ব আছে কিনা তা খোদ মাও সে তুংয়ের দেশ চিনের রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা গবেষণা করে হন্যে হয়েছেন। তবে আধুনিক চিনের প্রতিষ্ঠাতা ও চিনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মাওয়ের কিছু নীতিকে নিয়ে সশস্ত্র রাজনৈতিক আন্দোলন ভারতে সেই সত্তর দশকে ছিল তীব্র আলোচিত। সেই ধারার আধুনিক নাম মাওবাদ। (Pataliputra) বিহার ছিল সেই তত্ত্বের বিশেষ পরীক্ষাগার।

ভারতে সশস্ত্র কৃষক আন্দোলনের আকাশে ‘লাল তারা’ হয়ে আছে দার্জিলিং জেলার নকশালবাড়ি সশস্ত্র কৃষক আন্দোলন। এই আন্দোলনের অনেক আগে এ দেশে সশস্ত্র কৃষক আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে। সেই বিখ্যাত সশস্ত্র তেভাগা ও তেলেঙ্গানা মতো কৃষক বিদ্রোহের সময় চিনে চলছিল সে দেশের জনগণের বিপ্লব। জাপানি হামলা ও চিনা রাজ শক্তির বিরুদ্ধে এই বিপ্লবের নেতৃত্বে ছিলেন কিংবদন্তি কমিউনিস্ট নেতা মাও সে তুং। তাঁর রাজনৈতিক তত্ত্ব তৎকালীন সময়ে বিশ্বজুড়ে আলোচিত হলেও তখনকার ভারতে সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহে মাও তেমন প্রভাব ফেলেননি। পরে ষাটের দশক থেকে মাওয়ের তত্ত্ব ও চিনের বিপ্লব এক করে এদেশে যে রাজনৈতিক পথ নেওয়া হয়েছিল তারই আজকের চরিত্র মাওবাদী।

আগেই লিখেছি আজকের মাওবাদীদের দুই প্রধান পূর্বসূরি এমসিসি ও জনযুদ্ধ গোষ্ঠীর কথা। তাদের লাল চোখে কেঁপে যেত বিহারের সামন্তবাদ। দলিত, অন্ত্যজ শ্রেণীকে সামাজিক অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে শিখিয়েছিল এমসিসি ও জনযুদ্ধ। ভয়াবহ সে সব মুহূর্ত।

‘মৃত্যুদণ্ড’
এমসিসি পলিটব্যুরো বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে এই সিদ্ধান্ত স্থির হয়েছে। বিহারের মাটি জিঘাংসার প্রহর পার করছিল।

https://video.incrementxserv.com/vast?vzId=IXV533296VEH1EC0&cb=100&pageurl=https://kolkata24x7.in&width=300&height=400

অনেক রাত তখন। বিশাল মাঠের পাশে ঝোপে ঝোপে জোনাকি ঝিকঝিক করছে। ছায়ার মতো কয়েকজন নিঃশব্দে ঢুকল দালেলচক গ্রামের বড় রাস্তা দিয়ে। এদিকটা রাজপুতদের শক্তিশালী ঘাঁটি। এরা ছেড়ে দেবে না সহজে। মাঠ পেরিয়ে অন্যপাশে বাঘৌরা গ্রামেও রাজপুতরা আছে বড়সংখ্যায়। তবে ওখানে যাদবরা শক্তিশালী। নিঃশব্দে এগিয়ে চলা এমসিসি দলের হামলাকারীরা অতি সতর্ক। দু’ভাগে ঢুকছে তারা।

রাত নেমেছে। রেডিওতে বিবিধ ভারতীর গানে ঔরঙ্গাবাদ জেলার দুটি জমজ গ্রাম দালেলচক-বাঘৌরা গ্রাম ঢুকে। নমস্কার, ইয়ে হ্যায় বিবিধ ভারতী। অব আপ শুনেঙ্গে সুনহেরি পল। ঝুমরি তিলাইয়া সে ফরমাইস কিয়ে হ্যায়…গান শুনতে শুনতে ঝিমিয়ে পড়েছে দুটি জনপদ।

ঠিক এই সময় মৃত্যু দূতেরা ঘিরছে চারিদিক থেকে। পরস্পরের দিকে ঠাণ্ডা চোখে তাকায় সবাই।

শালে মাদারি ই ই ই…ই লে …
গুলির ঝড় বয়ে গেল দালেলচকে। ঘরে ঘরে ঢুকে রাজপুত সামন্তদের পাখি শিকারের মতো মারতে শুরু করল এমসিসি ক্যাডারস।
বন্দুক দেখে কেউ বলছে-
-ছোড় দে, ইয়ে মেরা পতি হ্যায়। কুুছ নেহি জানতা।
-হাঁ ছোড় দেঙ্গে। ই লে ছোড় দিয়া। পায়ের তলায় পড়ে থাকা সেই রাজপুতের মাথায় কয়েকটা গুলি গেঁথে গেল।
সব ঘরেই একই অবস্থা। ঘরে ঘরে দেয়ালে ঝোলানো বন্দুকগুলো নামানোর সময় পায়নি কেউ। তার আগেই লাসের পর লাস পড়ছিল দালেলচকে।

দালেলচকের উল্টোদিকের বাঘৌরা থেকে ভেসে আসছে গুলির শব্দ, কান্না। লাসের স্তূপ জমা হচ্ছিল সেখানেও। যারা পেরেছে নিজেদের বন্দুক নিয়ে অন্ধকারে লাফ মেরেছে মাঠের দিকে। যাওয়ার আগে পড়ে থাকা জমাট রক্ত ছুঁয়ে বলে গেছে- বদলা হোগা। দেখেঙ্গে শালো।

বদলা!
রক্তচরিত্র এখানেই যেন অট্টহাসি করে ওঠে। এই শব্দের মধ্যেই তো তার জীবন। বদলার বদলে বদলা। তার বদলে…এভাবেই রক্তচরিত্র বেঁচে থাকবে অনন্ত সময়।

১৯৮৭ সালের ২৯ মে। বিহারের বুকে সংঘঠিত হয়েছিল দালেলচক-বাঘৌরা গণহত্যা। উঁচু জাতির রাজপুতদের খুনে মাতোয়ারা যাদবরা। তাদের জন্য এমসিসি বাহিনী নেমেছিল রক্তগঙ্গা বইয়ে দিতে। সফল হয় তারা।আসলে এই গণহত্যার পিছনে আছে সেই জমি দখল ও জোতদারদের রক্তচোখের পুরনো কথা। রাজপুত বনাম যাদবদের সংঘর্ষ।

বিহারের বিভিন্ন মঠ ও মন্দিরে ব্রাহ্মণ, রাজপুত মোহন্তদের কব্জায় আছে বিপুল সরকারি জমি। কিন্তু তাদের চাহিদা আরো। দরকার যাদবদের জমি। এই নিয়েই ছুটকো ছাটকা সংঘর্ষ লেগেই থাকে ঔরঙ্গাবাদে। কখনো এপক্ষ কয়েকজনকে মারে তো অপরপক্ষ তার বদলা নেয়। জমি ও জাতের এই সংঘর্ষময় রক্তচরিত্র অচিরেই জন্ম দেয় তৃতীয় শক্তির। সামন্তবাদ বিরোধী রাজনৈতিক অবস্থান থেকেই এমসিসি সংগঠনটি তৃতীয় পক্ষ হয়ে যাদবদের মধ্যে ছড়ায় দ্রুত। এরই ফল দালেলচক ও বাঘৌরা গ্রামের গণহত্যা।

কতজনের মৃত্যু হয়েছিল তার সঠিক হিসেব নেই। সরকারি হিসেবে দালেলচক ও বাঘৌরা গ্রামে এমসিসি হামলায় কম করেও ৪৫ জন মারা যান। বেসরকারি হিসেবে ৫০ জনের বেশি মৃত। সবাই উঁচু জাত-রাজপুত। ভয়াবহ এই ঘটনা বিহারকে ফের একবার সংবাদ শিরোনামে এনে দেয়।

এমসিসি (মাওয়েস্ট কমিউনিস্ট সেন্টার) এই নামটি তখন ত্রাস। পাটনায় প্রবল আলোড়ন পড়েছে। কে ধরবে কাকে ? কংগ্রেসের রাজপুত গোষ্ঠী বদলা নিতে রাগে ফুঁসছে। যে রাজপুতনা বহু যোদ্ধাকে নাকানি চোবানি খাইয়েছিল সেই মাটির জনগোষ্ঠী রাজপুত রক্ত তো কম গরম নয়। মুখ্যমন্ত্রীর গদি নিয়েই টানাটানি শুরু হলো। ক্ষমতা থেকে সরে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী বিন্দেশ্বরী দুবে।

সে এক টালমাটাল সময়। বাঁদর নাচন নাচছে সবাই। অলক্ষ্যে রক্তচরিত্র খুঁজছিল পরের শিকার। (চলবে)

গত পর্ব: Pataliputra: মাওবাদীদের পূর্বসূরী এমসিসি ও জনযুদ্ধর গুলির লড়াইতে রক্তাক্ত হয়েছিল বিহার