বর্ষা বাঙালির জীবনে শুধু কবিতার ছন্দ বা স্মৃতির ভিজে গন্ধ নয়, পাতে ইলিশও (Hilsa) নিয়ে আসে। বছরের এই সময়টায় কলকাতার বাজারে ভোর থেকেই শুরু হয় ইলিশ কেনার হিড়িক। কেউ কিনছেন ভাপা ইলিশ বানানোর জন্য, কেউ সর্ষের ঝাঁঝে ভরপুর সর্ষে ইলিশের (Hilsa) স্বাদ নিতে মুখিয়ে আছেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়—যে মাছ নিয়ে বাংলাদেশিদের সবচেয়ে বেশি গর্ব, সেই ইলিশ এ বছর বাংলাদেশি গৃহস্থের পাতে প্রায় নেই বললেই চলে।
বাংলাদেশে ইলিশ (Hilsa) শুধু মাছ নয়, সংস্কৃতির অংশ। পদ্মার ইলিশ খাওয়ার গর্ব ও ঐতিহ্য প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসছে। গত বছর পদ্মা থেকে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়েছিল। তখন কম দামে সহজেই বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের পাতে সেই ইলিশ (Hilsa) পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু এ বছর চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো। ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামের বাজারে গেলেই দেখা যাচ্ছে—১ কেজির ইলিশের দাম ২৫০০ থেকে ৩০০০ টাকা। তুলনায় কলকাতার বাজারে একই ওজনের ইলিশ মিলছে ১৫০০–১৭০০ টাকায়। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, বাংলাদেশে এখন দুই কেজি মাটনের দামও ইলিশের চেয়ে কম!
প্রশ্ন ওঠে—এ বছর কি তবে ইলিশের (Hilsa) জোগান কম? পরিসংখ্যান বলছে, তা নয়। বরং বিগত বছরের মতো এ বছরও জেলেদের জালে ভালোই ইলিশ উঠছে। বঙ্গোপসাগর, পদ্মা—সব জায়গা থেকেই যথেষ্ট পরিমাণে মাছ ধরা পড়ছে। অর্থাৎ বাজারে সরবরাহের কোনো ঘাটতি নেই। তারপরও দাম এত আকাশছোঁয়া কেন—তার উত্তর দিতে পারছেন না বিশেষজ্ঞরাও। বাংলাদেশের একাধিক ইলিশ গবেষক ও মৎস্য ব্যবসায়ী বিষয়টিকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ বলে উল্লেখ করেছেন।
প্রতি বছরই ইলিশ ধরার জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ সরকার। এর উদ্দেশ্য—ডিম ছাড়ার মৌসুমে ইলিশকে সুরক্ষা দেওয়া ও উৎপাদন বাড়ানো। চলতি বছর প্রথমবার সেই সময়সূচিতে পরিবর্তন আনা হয়। ১৫ এপ্রিল থেকে ১১ জুন পর্যন্ত ইলিশ (Hilsa) (Hilsa) ধরা বন্ধ রাখা হয়। উদ্দেশ্য ছিল—জোগান বাড়ানো। কিন্তু বাস্তবে তাতে দাম কমেনি, বরং সাধারণ ক্রেতার নাগালের বাইরে চলে গেছে ইলিশ। ব্যবসায়ীদের একাংশের মতে, এই সময় পরিবর্তনের বাস্তব সুফল তেমন পাওয়া যায়নি।
অন্যদিকে, ভারতের বাজারে পরিস্থিতি ভিন্ন। আগে পদ্মার ইলিশ প্রচুর পরিমাণে পশ্চিমবঙ্গে আসত। কিন্তু এ বছর এখনও পর্যন্ত সেই আমদানি হয়নি। তবু কলকাতা, মুম্বই, গুজরাটের বাজারে ইলিশ তুলনামূলক সস্তা। কারণ, ভারতীয় বাজারে এখন মূলত বঙ্গোপসাগর ও মায়ানমার থেকে ধরা ইলিশ (Hilsa) আসছে। আমদানি হওয়ায় দাম তুলনামূলক বেশি হওয়ার কথা থাকলেও, বাংলাদেশে এবারের পরিস্থিতি উল্টো। কলকাতায় যেখানে ৫০০–৬০০ গ্রামের ইলিশ ৬৫০ টাকা থেকেই পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে একই ওজনের মাছের দাম ১০০০ টাকার ওপরে।
বাংলাদেশের জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম প্রথম আলো-এর তথ্য অনুযায়ী, কেজি প্রতি ইলিশের দাম ভারতে তুলনায় অন্তত ৪০০ টাকা বেশি। ফলে, মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো ইলিশ (Hilsa) কেনা থেকে ক্রমশ সরে যাচ্ছেন। আগে বর্ষায় সপ্তাহে অন্তত একদিন ইলিশ খাওয়ার রীতি ছিল অনেক বাড়িতে, এখন সেটা কমে বছরে কয়েকবারে নেমে এসেছে।
মজার ব্যাপার, বাংলাদেশে ইলিশের জোগান কম না হলেও বাজারে যে দামের তারতম্য দেখা যাচ্ছে, তার পেছনে অনেকে দায়ী করছেন বাজার নিয়ন্ত্রণের দুর্বলতা, পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি এবং পাইকারি পর্যায়ে অতিরিক্ত মুনাফা নেওয়ার প্রবণতাকে। আবার কেউ কেউ বলছেন, ইলিশ রপ্তানির সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে স্থানীয় বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হচ্ছে। যদিও সরকারি পর্যায় থেকে এই অভিযোগের কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ মেলেনি।
সব মিলিয়ে বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশের পাতে ইলিশের (Hilsa) অভাব যেন এক অদ্ভুত ব্যঙ্গ। নদীমাতৃক দেশের মানুষেরা যখন নিজেদের প্রিয় মাছ কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন, তখন সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে তুলনামূলক কম দামে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। গর্বের ইলিশ এখন বাংলাদেশে যেন উচ্চবিত্তদের বিলাসবহুল খাবারে পরিণত হয়েছে, আর মধ্যবিত্তর স্বপ্নের থালায় থেকে যাচ্ছে কেবল স্মৃতি আর স্বাদহীন আফসোস।