ভারতের অর্থনীতির জন্য বেকারত্ব একটি বড় চ্যালেঞ্জ, বিশেষ করে শিক্ষিত বেকার যুবকদের জন্য (Loans for Unemployedv) যারা কাজের অভাবে হতাশ এবং অর্থনৈতিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়ছেন। এই সমস্যা মোকাবেলায় ভারত সরকার এবং বিভিন্ন রাজ্য সরকার বেকার যুবকদের জন্য বিভিন্ন ঋণ প্রকল্প চালু করেছে, যা তাদের স্বনির্ভর করে তুলতে এবং নিজস্ব উদ্যোগ শুরু করতে সহায়তা করে। প্রধানমন্ত্রী রোজগার যোজনা (পিএমআরওয়াই), প্রধানমন্ত্রী মুদ্রা যোজনা (পিএমএমওয়াই), এবং তামিলনাড়ুর নিউ এন্ট্রাপ্রিনিয়র অ্যান্ড এন্টারপ্রাইজ ডেভেলপমেন্ট স্কিম (নিডস) এর মতো প্রকল্পগুলি বেকার যুবকদের জন্য আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয়। তবে, এই প্রকল্পগুলির পিছনে থাকা দাবির সত্যতা কী? এই প্রতিবেদনে আমরা বেকার যুবকদের জন্য ঋণের সুযোগ, তাদের যোগ্যতার শর্ত, এবং এই প্রকল্পগুলির সীমাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনা করব।
বেকার যুবকদের জন্য ঋণ প্রকল্প: একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ
প্রধানমন্ত্রী রোজগার যোজনা (পিএমআরওয়াই) ১৯৯৩ সালে চালু হয়েছিল, যার লক্ষ্য ছিল শিক্ষিত বেকার যুবকদের স্ব-নিয়োজনের সুযোগ প্রদান করা। এই প্রকল্পের অধীনে, ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী যুবকরা, যারা ন্যূনতম অষ্টম শ্রেণি পাস করেছেন, তারা ব্যবসায়িক খাতে ২ লক্ষ টাকা এবং শিল্প বা সেবা খাতে ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণ পেতে পারেন। এসসি/এসটি, মহিলা, প্রাক্তন সেনা সদস্য এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য বয়সের সীমা ৪০ বছর পর্যন্ত শিথিল করা হয়েছে। এই ঋণের জন্য কোনো প্রক্রিয়াকরণ ফি নেই এবং ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত প্রকল্পের জন্য কোনো জামানতের প্রয়োজন হয় না। তবে, আবেদনকারীদের অবশ্যই একটি ঋণের ডিফল্টের ইতিহাস না থাকতে হবে এবং তাদের পারিবারিক আয় বার্ষিক ৪০,০০০ টাকার নিচে হতে হবে।
তামিলনাড়ুর নিডস প্রকল্পটি স্নাতক বেকার যুবকদের জন্য ২৫% ভর্তুকি সহ ঋণ প্রদান করে। এই প্রকল্পের অধীনে, ২১ থেকে ৩৫ বছর বয়সী উদ্যোক্তারা ৫ লক্ষ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ পেতে পারেন, যার জন্য ব্যাংকের দ্বারা নির্ধারিত জামানত প্রয়োজন। এসসি/এসটি, মহিলা এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য বয়সের সীমা ৪৫ বছর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কর্ম সাথী প্রকল্প ২০২০ সালে চালু হয়েছে, যা ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সী বেকারদের জন্য ২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত সহজ ঋণ এবং ৫০% সুদের ভর্তুকি প্রদান করে। এই প্রকল্পের লক্ষ্য বার্ষিক ১ লক্ষ উপকারভোগীকে সহায়তা করা।
কৃষি খাতে নিয়োজিত বেকার যুবকদের জন্য কৃষি ঋণ প্রকল্প রয়েছে, যেখানে ২২ বছরের বেশি বয়সী কৃষি স্নাতকরা বিভিন্ন ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঋণ পেতে পারেন। এই ঋণগুলি কৃষি সংক্রান্ত প্রকল্প, যেমন জমি ক্রয় বা কৃষি সরঞ্জাম ক্রয়ের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
দাবির পিছনের সত্যতা
এই প্রকল্পগুলি বেকার যুবকদের জন্য আশার আলো জাগালেও, বাস্তবতা এতটা সহজ নয়। প্রথমত, এই ঋণগুলির জন্য যোগ্যতার শর্ত কঠোর। পিএমআরওয়াই-এর জন্য, আবেদনকারীদের একটি বিস্তারিত প্রকল্প পরিকল্পনা জমা দিতে হয় এবং জেলা শিল্প কেন্দ্রে (ডিআইসি) সাক্ষাৎকারে অংশ নিতে হয়। ঋণ অনুমোদনের প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ এবং জটিল হতে পারে, যা অনেক বেকার যুবকের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
দ্বিতীয়ত, যদিও পিএমআরওয়াই এবং নিডসের মতো প্রকল্পগুলি জামানত-মুক্ত ঋণের প্রতিশ্রুতি দেয়, অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলি অতিরিক্ত নথি বা গ্যারান্টারের দাবি করে। উদাহরণস্বরূপ, তামিলনাড়ুর নিডস প্রকল্পে ব্যাংকগুলি প্রায়ই জামানতের জন্য সম্পত্তি বা অন্যান্য সম্পদের দাবি করে, যা অনেক বেকার যুবকের পক্ষে সরবরাহ করা কঠিন। এছাড়াও, ঋণ পরিশোধের সময়সীমা ৩ থেকে ৭ বছরের মধ্যে হলেও, উচ্চ সুদের হার এবং আর্থিক অস্থিরতার কারণে অনেকে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হন, যা তাদের আরও ঋণের ফাঁদে ফেলতে পারে।
তৃতীয়ত, সরকারি প্রকল্পগুলির প্রচার এবং সচেতনতার অভাব অনেক বেকার যুবকের কাছে এই সুযোগগুলি পৌঁছাতে বাধা দেয়। গ্রামীণ এলাকায়, যেখানে বেকারত্বের হার বেশি, তথ্যের অভাব এবং জটিল আবেদন প্রক্রিয়া কৃষক এবং যুবকদের এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিমবঙ্গের কর্ম সাথী প্রকল্পের জন্য আবেদন করতে হলে আবেদনকারীদের রাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দা হতে হবে এবং অনলাইন পোর্টালে নিবন্ধন করতে হবে, যা ডিজিটাল সাক্ষরতার অভাবে অনেকের জন্য কঠিন।
বিকল্প সমাধান এবং চ্যালেঞ্জ
বেকার যুবকদের জন্য ঋণের বিকল্প হিসেবে সুরক্ষিত ঋণ, যেমন সম্পত্তি বা সোনার বিনিময়ে ঋণ, এবং নন-ব্যাংকিং ফাইনান্সিয়াল কোম্পানি (এনবিএফসি) থেকে ব্যক্তিগত ঋণ পাওয়া যায়। তবে, এই ঋণগুলির সুদের হার সাধারণত বেশি এবং একটি ভালো ক্রেডিট স্কোর (৭৫০ বা তার বেশি) প্রয়োজন। যদি কোনো বেকার যুবকের ক্রেডিট স্কোর কম থাকে, তবে ঋণ পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এছাড়াও, সোনা বা সম্পত্তির মতো জামানত অনেকের কাছে থাকে না, যা তাদের এই বিকল্প থেকে বঞ্চিত করে।
সরকারি ঋণ প্রকল্পগুলির আরেকটি সীমাবদ্ধতা হল এগুলি প্রধানত ব্যবসা শুরু করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে, কিন্তু শিক্ষা বা জরুরি আর্থিক প্রয়োজনের জন্য এই ঋণগুলি উপযুক্ত নয়। উদাহরণস্বরূপ, পিএমআরওয়াই কৃষি ফসল উৎপাদন বা সার ক্রয়ের মতো সরাসরি কৃষি কার্যক্রমের জন্য ঋণ প্রদান করে না।
সমাধানের পথ
বেকার যুবকদের জন্য ঋণ প্রকল্পগুলির কার্যকারিতা বাড়াতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, সরকারের উচিত এই প্রকল্পগুলির প্রচার বাড়ানো এবং গ্রামীণ এলাকায় সচেতনতা ক্যাম্পেইন চালানো। দ্বিতীয়ত, আবেদন প্রক্রিয়া সরল করা এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলিকে আরও ব্যবহারকারী-বান্ধব করা উচিত। তৃতীয়ত, ঋণ পরিশোধের জন্য আরও নমনীয় সময়সীমা এবং কম সুদের হার প্রদান করা যেতে পারে। এছাড়াও, ন্যানো-ইউরিয়ার মতো উদ্ভাবনী সমাধান এবং জৈব সারের প্রচার কৃষি খাতে বেকার যুবকদের জন্য সহায়ক হতে পারে।
বেকার যুবকদের জন্য ঋণ প্রকল্পগুলি তাদের স্বনির্ভর করে তুলতে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে, জটিল আবেদন প্রক্রিয়া, কঠোর যোগ্যতার শর্ত এবং তথ্যের অভাব এই প্রকল্পগুলির কার্যকারিতা হ্রাস করে। সরকার এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির সমন্বিত প্রচেষ্টা এবং সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে এই প্রকল্পগুলি আরও কার্যকর হতে পারে। বেকার যুবকদের জন্য ঋণ একটি সম্ভাবনাময় সুযোগ হলেও, এর পিছনের দাবির সত্যতা বোঝা এবং সঠিক পরিকল্পনার সাথে এগিয়ে যাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।