সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে বেশ কিছু আলোচনা শুরু হয়েছে। ওয়াকফ সম্পত্তি (Waqf Property) হল ইসলামিক আইন অনুযায়ী ধর্মীয় বা চ্যারিটেবল উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট করা সম্পত্তি, যা ব্যবহার বা বিক্রয়ের জন্য নিষিদ্ধ। ওয়াকফ অ্যাসেটস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম অফ ইন্ডিয়া (WAMSI) এর তথ্য অনুযায়ী, ভারত জুড়ে মোট ৮,৭২,৮০৪টি অচল ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে, যা বিশ্বের বৃহত্তম ধর্মীয় ও সম্প্রদায়ভিত্তিক জমির ভাণ্ডারগুলির একটি হিসেবে গণ্য হয়। এই সম্পত্তিগুলোর মধ্যে রাজ্যভিত্তিক বিতরণ বিষয়ে আলোচনা চলছে, এবং তথ্য প্রকাশের পর থেকে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে। আজ আমরা জানবো, পশ্চিমবঙ্গ যেহেতু ওয়াকফ সম্পত্তিতে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে, প্রথম স্থানে কোন রাজ্য অবস্থান করছে।
ওয়াকফ সম্পত্তির পরিসংখ্যান
WAMSI-এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, উত্তর প্রদেশ রাজ্যটি ওয়াকফ সম্পত্তির দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে, যেখানে মোট ২,৩২,৫৪৭টি অচল ওয়াকফ সম্পত্তি নিবন্ধিত রয়েছে। এর পরেই আসে পশ্চিমবঙ্গ, যেখানে ৮০,৭৪৪টি ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে। তৃতীয় স্থানে রয়েছে পঞ্জাব (৭৫,৯৬৫), এবং তামিলনাড়ু (৬৬,০৯২) ও কর্ণাটক (৬২,৮৩০) এই তালিকায় উল্লেখযোগ্য। এই তথ্যগুলো থেকে বোঝা যায় যে উত্তর প্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে একটি বড় প্রভেদ রয়েছে, যা এই রাজ্যগুলোর ইতিহাস, জনসংখ্যা ও সাংস্কৃতিক গঠনের সঙ্গে সম্পর্কিত।
উত্তর প্রদেশের অবদান
উত্তর প্রদেশ কেন এত বেশি ওয়াকফ সম্পত্তির অধিকারী? এর পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, উত্তর প্রদেশ ইতিহাসের দিক থেকে ইসলামী সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে গণ্য হয়। এখানে তাজমহল, আগ্রার কেল্লা এবং লখনউয়ের ইমামবাড়ার মতো ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে, যেগুলোর সঙ্গে ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা গভীরভাবে জড়িত। দ্বিতীয়ত, রাজ্যের বৃহৎ মুসলিম জনসংখ্যা (প্রায় ২০% জনগোষ্ঠী) এই সম্পত্তিগুলোর সংখ্যা বাড়াতে সহায়তা করেছে। তৃতীয়ত, বহু শতাব্দী ধরে এই সম্পত্তিগুলো ধর্মীয় উদ্দেশ্যে দান করা হয়েছে, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই বৃহৎ সংখ্যার সৃষ্টি করেছে।
পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান
পশ্চিমবঙ্গ দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও এর অবদান অগ্রাহ্য করা যায় না। রাজ্যে ৮০,৭৪৪টি ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে, যা উত্তর প্রদেশের পরে সবচেয়ে বেশি। এর কারণ হলো বাংলার ইতিহাসে মুঘল আমলের প্রভাব এবং ব্রিটিশ শাসনকালে ওয়াকফ সিস্টেমের বিস্তার। কলকাতা, মুর্শিদাবাদ এবং মালদা জেলা যেখানে ইসলামী সংস্কৃতির গভীর প্রভাব রয়েছে, সেখানে ওয়াকফ সম্পত্তির সংখ্যা বেশি। তবে, পশ্চিমবঙ্গে এই সম্পত্তিগুলোর ব্যবস্থাপনায় অনেক সমস্যা রয়েছে, যেমন অবৈধ দখল এবং পরিচালনার অভাব।
ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবহার ও চ্যালেঞ্জ
ওয়াকফ সম্পত্তি শুধুমাত্র মসজিদ বা দরগাহে সীমাবদ্ধ নয়; এর মধ্যে জমি, আশুরখানা, মাদ্রাসা এবং অন্যান্য বিভাগের সম্পত্তিও রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, WAMSI-এর তথ্য অনুযায়ী, ভারত জুড়ে ৬৪,৭২৪টি প্লট, ১৭,৭১৯টি আশুরখানা এবং ১৪,০০৮টি মাদ্রাসা ওয়াকফের আওতায় রয়েছে। তবে, এই সম্পত্তিগুলোর প্রায় ৩% অবৈধ দখলের শিকার হয়েছে, যা মধ্যপ্রদেশ, পঞ্জাব ও পশ্চিমবঙ্গে বেশি দেখা যায়। এই সমস্যা নিরসনে সরকার ২০২৫ সালে UMEED পোর্টাল চালু করেছে, যা সম্পত্তিগুলোর ডিজিটাল নথিভূক্তকরণে সাহায্য করবে।
সরকারি উদ্যোগ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
কেন্দ্রীয় সরকার ওয়াকফ সম্পত্তির পরিচালনা উন্নত করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে। ওয়াকফ (সংশোধন) বিল ২০২৫ এর মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালের গঠন পুনর্গঠন, সম্পত্তি নিবন্ধন প্রক্রিয়া উন্নত করা এবং ওয়াকফ বোর্ড ও মুতাওয়ালিদের দায়িত্ব নির্ধারণের মতো কঠোর নিয়ম চালু করা হয়েছে। এই পদক্ষেপগুলোর মাধ্যমে সম্পত্তির সঠিক ব্যবহার এবং দখলদারদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে।
সমাজে প্রভাব
ওয়াকফ সম্পত্তি শুধুমাত্র ধর্মীয় উদ্দেশ্যে নয়, সমাজকল্যাণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর মাধ্যমে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং দরিদ্রদের সাহায্যের কাজ চলে। তবে, যদি এই সম্পত্তিগুলোর ব্যবস্থাপনা সঠিক না হয়, তাহলে এর ফলে সমাজে অর্থনৈতিক ক্ষতি হতে পারে। উত্তর প্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে এই সম্পত্তিগুলোর বৃহৎ সংখ্যা তাদের সম্ভাব্য প্রভাবকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
সুতরাং, ওয়াকফ সম্পত্তিতে উত্তর প্রদেশ প্রথম স্থানে এবং পশ্চিমবঙ্গ দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করছে। এই সম্পত্তিগুলোর সংরক্ষণ ও ব্যবহার নিয়ে সরকার ও সমাজের সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি। ভবিষ্যতে ডিজিটালকরণ ও সঠিক পরিচালনার মাধ্যমে এই সম্পদগুলোর পূর্ণ সম্ভাবনা উন্মোচিত হতে পারে, যা ভারতের মৌলিক বৈচিত্র্য ও ঐতিহ্যকে আরও সমৃদ্ধ করবে।