কোচবিহারের মেখলা শাড়ি অসমে জনপ্রিয়, তাঁতশিল্পীদের মুখে হাসি

অয়ন দে, কোচবিহার: বাংলার তাঁতশিল্পের ঐতিহ্য আবারও নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। কোচবিহারের হাতে বোনা মেখলা শাড়ি (Mekhela Sarees) এখন উত্তর-পূর্ব ভারতের অসমে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে,…

Cooch Behar’s Handwoven Mekhela Sarees Gain Popularity in Assam, Boosting Artisans’ Income

অয়ন দে, কোচবিহার: বাংলার তাঁতশিল্পের ঐতিহ্য আবারও নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। কোচবিহারের হাতে বোনা মেখলা শাড়ি (Mekhela Sarees) এখন উত্তর-পূর্ব ভারতের অসমে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, যা স্থানীয় তাঁতশিল্পীদের জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। এই শাড়িগুলির চাহিদা বৃদ্ধির ফলে শিল্পীদের আয় বেড়েছে, এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে নতুন প্রাণ সঞ্চারিত হয়েছে।

কোচবিহার ও অসম প্রতিবেশী রাজ্য হওয়ায় দুই অঞ্চলের মধ্যে যোগাযোগ ও সাংস্কৃতিক মিল রয়েছে। অসমের মহিলারা মেখলা শাড়ির ঐতিহ্যবাহী ডিজাইন ও আরামদায়ক ফ্যাব্রিকের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন। এই শাড়িগুলি অসমের বিভিন্ন উৎসব, বিবাহ এবং সামাজিক অনুষ্ঠানে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে কোচবিহারের তাঁতশিল্পীরা তাদের পণ্যের জন্য একটি স্থিতিশীল ও লাভজনক বাজার খুঁজে পেয়েছেন।

   

স্থানীয় তাঁতশিল্পী ধনঞ্জয় দাস জানান, “অসমে আমাদের মেখলা শাড়ির চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। আমরা প্রতিটি শাড়ি তৈরি করে গড়ে ৫০০ টাকা লাভ করি। অসমের বাজারে এই শাড়িগুলি ২,০০০ থেকে ৩,০০০ টাকায় বিক্রি হয়।” তিনি আরও বলেন, “অসমের ব্যবসায়ীরা নিজেরাই কোচবিহারে এসে শাড়ি কিনে নিয়ে যান। এতে আমাদের আলাদা করে বিপণনের ঝামেলা পোহাতে হয় না।” এই সুবিধার কারণে তাঁতশিল্পীরা উৎপাদনের দিকে বেশি মনোযোগ দিতে পারছেন, এবং তাদের পণ্য বিক্রি নিয়ে কোনও দুশ্চিন্তা থাকছে না।

মেখলা শাড়ি তৈরির প্রক্রিয়া একটি শ্রমসাধ্য ও দক্ষতার কাজ। এই শাড়িগুলি তাঁতে হাতে বোনা হয়, এবং প্রতিটি শাড়িতে ফুটে ওঠে ঐতিহ্যবাহী নকশা ও শিল্পকলা। কোচবিহারের তাঁতশিল্পীরা সুতি, সিল্ক এবং মিশ্র ফ্যাব্রিক ব্যবহার করে এই শাড়ি তৈরি করেন। ফ্লোরাল প্যাটার্ন, জ্যামিতিক নকশা এবং স্থানীয় সংস্কৃতি থেকে অনুপ্রাণিত মোটিফ এই শাড়িগুলিকে অনন্য করে তোলে। একটি মেখলা শাড়ি তৈরি করতে কয়েক দিন থেকে সপ্তাহ লাগতে পারে, যা শিল্পীদের ধৈর্য ও নিষ্ঠার পরিচয় বহন করে।

কোচবিহারের তাঁতশিল্পীদের এই সাফল্য শুধু তাদের ব্যক্তিগত আয় বাড়ায়নি, বরং স্থানীয় অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তাঁতশিল্পের এই পুনরুজ্জীবন তরুণ প্রজন্মের মধ্যেও এই ঐতিহ্যবাহী পেশার প্রতি আগ্রহ জাগাচ্ছে। তবে, শিল্পীরা মনে করছেন, সরকারি সহায়তা এবং আধুনিক বিপণন কৌশলের মাধ্যমে এই শিল্পকে আরও বড় পরিসরে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব।

Advertisements

স্থানীয় তাঁতশিল্পী মঞ্জু বর্মন বলেন, “আমাদের তৈরি শাড়ি অসমে এতটা পছন্দ হচ্ছে, এটা আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। কিন্তু আমরা চাই, আরও বেশি মানুষ আমাদের শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হোক। সরকার যদি আমাদের জন্য প্রশিক্ষণ ও ঋণের ব্যবস্থা করে, তাহলে আমরা আরও বেশি উৎপাদন করতে পারব।” তিনি আরও জানান, ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তাদের পণ্যের প্রচার বাড়ানো গেলে, বাজার আরও প্রসারিত হবে।

কোচবিহারের তাঁতশিল্প শুধু একটি পেশা নয়, এটি বাংলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। অসমে এই শাড়ির চাহিদা বৃদ্ধি শিল্পীদের মধ্যে নতুন উৎসাহ জাগিয়েছে। তাঁরা এখন তাদের কারিগরি দক্ষতাকে আরও উন্নত করার পাশাপাশি নতুন নতুন ডিজাইন তৈরির দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন। এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে, কোচবিহারের তাঁতশিল্প শুধু অসম নয়, দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও নিজের স্থান করে নিতে পারবে।

সরকারি স্তরে তাঁতশিল্পীদের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প চালু রয়েছে, যেমন জাতীয় হস্ততাঁত উন্নয়ন কর্মসূচি এবং হস্ততাঁতশিল্পী কল্যাণ প্রকল্প। এই প্রকল্পগুলি শিল্পীদের জন্য প্রশিক্ষণ, আর্থিক সহায়তা এবং বাজার সংযোগের সুযোগ করে দিচ্ছে। তবে, তাঁতশিল্পীরা চান, এই সহায়তা আরও সহজলভ্য ও কার্যকর হোক।

কোচবিহারের এই সাফল্য গোটা বাংলার তাঁতশিল্পের জন্য একটি উদাহরণ। এটি প্রমাণ করে, ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে আধুনিক বাজারের সঙ্গে সংযুক্ত করতে পারলে, তা গ্রামীণ অর্থনীতির মেরুদণ্ড হয়ে উঠতে পারে। কোচবিহারের তাঁতশিল্পীরা এখন শুধু শাড়ি বুনছেন না, তারা বুনছেন নতুন স্বপ্ন, সম্ভাবনা এবং সমৃদ্ধির গল্প।