ভূতচতুর্দশীতে কেন খাবেন শাক, কেন জ্বালাবেন প্রদীপ? জেনে নিন

News Desk: ভূত চতুর্দশী। শব্দ দুটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে অন্ধকার রাত, আর গা ছমছমে সেই রাতে হয় তেনাদের বিচরণ। শারদোৎসব কাটিয়ে এবার পালা…

rituals of bhoot chaturdashi

News Desk: ভূত চতুর্দশী। শব্দ দুটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে অন্ধকার রাত, আর গা ছমছমে সেই রাতে হয় তেনাদের বিচরণ। শারদোৎসব কাটিয়ে এবার পালা আলোর উৎসবে মেতে ওঠার। আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা ত্রয়োদশীর দিন ধনতেরাস অথবা ধনত্রয়োদশী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দীপাবলি উৎসবের সূচনা হয়।

দীপান্বিতা অমাবস্যার আগে এই চতুর্দশী তিথিতেই পালিত হয় ভূত চতুর্দশী যা হল বাঙালী কালী পুজোর আগের দিন। আর এই ভূত চতুর্দশী ঘিরে রয়েছে বহু আচার, উপাচার। ভূত চতুর্দশীর দিনটিকে ঘিরে বাংলার সমাজ এবং সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে নানান আচার বিধি। একপাশে বিশ্বাসের সাথে জড়িয়ে থাকা গা ছমছমে ভূতের গল্প এবং অন্যদিকে রয়েছে বৈজ্ঞানিক যুক্তি। এই দুয়ের মিলমিশে আপাতত বাঙালি জাতি ভূতচতুর্দশীর দিন চোদ্দ শাক খাওয়ার নিয়ম সাদরে পালন করে আসছে।

বহু পরিবারেই চোদ্দ প্রদীপ জ্বালিয়ে চোদ্দ শাক খাওয়ার রীতি রয়েছে। কিন্তু কেন সংখ্যায় চোদ্দ? ভেবে দেখেছেন কখনও! অনেকের মধ্যেই ধন্দ তৈরি হয় এই চোদ্দ শাক ঠিক কী কী! কিংবা এই শাক খাওয়াটা আবশ্যিক কেন? এই সব কিছুর উত্তর পেয়ে যাবেন আজকে।

বহু কাল আগে থেকেই এই দিনে চোদ্দ পুরুষের উদ্দেশ্যে প্রদীপ জ্বালানোর রীতি রয়েছে। মনে করা হত, এদিনে তাঁদের আত্মা নেমে আসে। অতৃপ্ত আত্মার রোষানল থেকে মুক্তি পেতেই এই চোদ্দ শাকের আয়োজন।

প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, পূর্বপুরুষরা মৃত্যুর পর পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যায়। এই পঞ্চভূত বলতে বোঝায় মাটি, জল, হাওয়া, অগ্নি এবং আকাশ। সেই পূর্বপুরুষদের আশীর্বাদ পেতে তাঁদের উদ্দেশ্যে মাটি থেকে ১৪ রকমের শাক তুলতে হয়। এই শাক খেলে অতৃপ্ত আত্মার রোষানল থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

অঞ্চল ভেদে আবার এই ১৪ শাক ধোয়া জল বাড়িতে বিভিন্ন কোনে ছেটানোর রীতি ও রয়েছে। এই বিশেষ দিনে, পূর্বপুরুষদের কথা স্মরণ করে অন্নের সাথে সেই শাক খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। আবার পুরাণ অনুযায়ী, এই বিশেষ দিনে স্বর্গ এবং নরকের দরজা কিছুক্ষণের জন্য খোলা হয়। সেই উন্মুক্ত দ্বার দিয়েই বিদেহী আত্মা ও স্বর্গত ব্যক্তিরা নেমে আসেন পৃথিবীতে।

সেই বিশ্বাস থেকেই আজও পালিত হয় এই রীতি। এত গেল তত্ত্বের কথা, তবে এদিন কোন কোন চোদ্দ রকমের শাখ খেতে হয়?

ভূত চতুর্দশীর দিন যে চোদ্দ শাক খাওয়ার নিয়ম প্রচলিত রয়েছে, সে ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কতগুলি শাক রয়েছে। অনেক বিক্রেতাই বিভিন্ন ধরনের শাক কেটে একত্রে বিক্রি করেন। সে ক্ষেত্রে বিশেষ ১৪টি শাক থাকে কিনা সন্দেহ রয়েছে। তাই চেষ্টা করা হয় যে বাজার থেকে প্রত্যেকটি শাক আলাদা ভাবে কেনার।

এই শাক গুলি হল – পাট শাক, পুঁই শাক, কুমড়ো শাক, মুলো শাক, কলমি শাক, গিমে শাক, সর্ষে শাক, নোটে শাক, মেথি শাক, হিঞ্চে শাক, লাউ শাক, পালং শাক, লাল শাক, সুষনি শাক। যদিও অঞ্চলভেদে আবার এই শাকের ভিন্নতা দেখা যায়।

ভিন্নমতে অনেক জায়গায় প্রচলিত আছে ওল, কেঁউ, বেতো, সর্ষে, কালকাসুন্দে, নিম, জয়ন্তী, শাঞ্চে, হিলঞ্চ, পলতা, শৌলফ, গুলঞ্চ, ভাঁটপাতা এবং সুষনি।

চোদ্দ শাখের মধ্যে যে গুলো সাধারণত বাজারে বিক্রি করা হয় সেগুলি হল, ওল, বেতো, সরষে, পুঁই, শুশনি, নিম, মেথি, হিলঞ্চ, পলতা, শৌলফ, গুলঞ্চ, শুষণী, লাল, লাউ শাক ইত্যাদি। ইত্যাদি বললাম কারণ, স্থান বিশেষে কিছু ভিন্ন ভিন্ন শাকের প্রচলন ও ইতিহাস থাকতে পারে। বাজারে বাজারে এখন চোদ্দ শাক অনায়াসেই পাওয়া যায়, বিশ্বাস করে কিনে নিলেই হলো। কিন্তু বিষয়টি হচ্ছে-কারণটা কী ?

বাড়ির বড়রা সব সময়েই ‘এইটা করতে হয়’ বলে থাকেন, এটাই নিয়ম, তাই পালন করা হয়। তবে কেন এই নিয়ম! এবার আসা যাক মূল বিষয়ে, সংস্কার, কু সংস্কার এর তর্ক বিতর্ক এড়িয়ে বিজ্ঞান বলছে- চোদ্দ শাক খাওয়ার কারন হল- স্বাস্থ্য ভাল রাখা। এই মরশুমে আবহাওয়ার পরিবর্তন হয়, উত্তরের ঠাণ্ডা হাওয়া বইতে শুরু করে। তাই শরীরের রোগ সংক্রমণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্যই এই শাক খাওয়ার নিয়ম চালু করা হয়েছিল। আয়ুর্বেদ শাস্ত্র অনুযায়ী এই বিশেষ শাকগুলির মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে নানান রোগের সাথে মোকাবিলা করার শক্তি। এছাড়াও কালিপুজোর সময় ঋতু পরিবর্তনের কারণে প্রায় মানুষ কমবেশি সর্দি-কাশিতে ভোগেন। সে ক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে এই শাক গুলির জুড়ি মেলা ভার।

তার পাশাপাশি রয়েছে অন্ধকার রাতে ১৪ টি প্রদীপ জ্বালানোর রীতি। প্রেত ও অশুভ শক্তি দূর করতে এই দিন সন্ধেয় বাড়িতে ১৪ প্রদীপ জ্বালিয়ে থাকেন বাঙালি গৃহস্থরা।

পুরাণ মতে, দানবরাজ বলির স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল দখলের পরই নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে রাক্ষসরা। যে আক্রোশের শিকার হন দেবতারাও। বলির তাণ্ডব ঠেকাতে বৃহস্পতি বিষ্ণুকে একটি উপায় বলে দেন। বামনের ছদ্মবেশে আবির্ভূত হন বিষ্ণু। রাজা বলির কাছে তিন পা সমান জমি ভিক্ষা চান তিনি। তবে বলি বুঝতে পারেন, বামনের ছদ্মবেশে ইনি আসলে ভগবান বিষ্ণু। তা সত্ত্বেও ভিক্ষা দিতে রাজি হয়ে যান রাজা। এরপরই দু-পা দিয়ে স্বর্গ ও মর্ত্য দখল করে নেন বিষ্ণু। নাভি থেকে বেরিয়ে আসা তৃতীয় পা রাখেন স্বয়ং বলি রাজার মাথায়। বিষ্ণু পদস্পর্শে পাতালে নেমে যান বলি। সেই থেকে পাতালেই তাঁর বাস। তবে সব জেনেও বিষ্ণুকে ভিক্ষা দিতে রাজি হওয়ায় বলি হয়ে ওঠেন করুণার পাত্র। বিষ্ণু আশীর্বাদ দেন যে প্রতি বছর মর্ত্যে তাঁর পুজো করা হবে। মনে করা হয়, সেই থেকে কালীপুজোর আগের রাতে বলি রাজা পাতাল থেকে পুজো নিতে মর্ত্যে আসেন। সহচর হিসেবে সঙ্গে থাকে শত সহস্র ভূত ও অশরীরী!

তবে ১৪ শাক খাওয়া ও ১৪ প্রদীপ জ্বালানোর পিছনে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও রয়েছে। ঋতু পরিবর্তনের জন্য এই সময় নানা ধরনের অসুখ বিসুখ হয়ে থাকে। ১৪ শাক খেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। আবার হেমন্তের শুরুতে পোকার উপদ্রব দূর করতে বাড়িতে ১৪ প্রদীপ জ্বালানো হয়।