উপাসনার সময়েই মধ্যপ্রাচ্যের ধর্মীয়স্থানে ভয়াবহ বিস্ফোরণ

রবিবার সকালে মধ্যপ্রাচ্যের সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের (Damascus) উপকণ্ঠে অবস্থিত মার এলিয়াস গ্রিক অর্থোডক্স চার্চে একটি ভয়াবহ সুইসাইড বোমা হামলা ঘটেছে। এই হামলায় কমপক্ষে ৯ জন…

Suicide Bombing at Damascus Church

রবিবার সকালে মধ্যপ্রাচ্যের সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের (Damascus) উপকণ্ঠে অবস্থিত মার এলিয়াস গ্রিক অর্থোডক্স চার্চে একটি ভয়াবহ সুইসাইড বোমা হামলা ঘটেছে। এই হামলায় কমপক্ষে ৯ জন নিহত এবং অসংখ্য মানুষ আহত হয়েছে। সিরিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এই হামলায় প্রায় ১৫ থেকে ৩০ জন আহত হয়েছেন, যার মধ্যে শিশুও রয়েছে। ব্রিটেনভিত্তিক সিরিয়ান অবজার্ভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস (SOHR) জানিয়েছে যে আহত ও নিহতদের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। এই হামলা সিরিয়ায় গত কয়েক বছরে সর্বপ্রথম এ ধরনের ঘটনা হিসেবে গণ্য হচ্ছে, যা দেশের নতুন প্রতিরক্ষামূলক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে ধরেছে।

Read Hindi: मध्य पूर्व के धार्मिक स्थल पर पूजा के दौरान भयावह विस्फोट

   

ঘটনার পটভূমি
এই হামলাটি রোববার সকালে ঘটে, যখন চার্চে উপাসনা চলছিল। সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, একজন আইএসআইএস (ইসলামিক স্টেট) সংযুক্ত হামলাকারী চার্চের মধ্যে প্রবেশ করে প্রথমে অস্ত্র দিয়ে গুলি চালায় এবং পরে নিজের ওপর পরিহিত বিস্ফোরক বস্তু ফাটিয়ে ফেলে। এই হামলার ফলে চার্চের ভিতরে বিস্তৃত ক্ষতি হয়েছে—আলতার ভেঙে পড়েছে, বেঞ্চে কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে পড়েছে এবং মেঝেতে রক্তের দাগ

দেখা গেছে। সিরিয়ান সিভিল ডিফেন্স (হোয়াইট হেলমেটস) এর প্রকাশিত ছবি ও ভিডিও থেকে এই ধ্বংসাবশেষ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
সাক্ষীদের বর্ণনা অনুযায়ী, একজন চশমদিদার রাওয়াদ নামে এক ব্যক্তি জানিয়েছেন যে হামলাকারী দুজন সঙ্গীসহ চার্চের কাছে এসে গুলি চালাতে শুরু করে এবং পরে ভিতরে প্রবেশ করে নিজেকে বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেয়। এই ঘটনার পর স্থানীয় নিরাপত্তা বাহিনী ও প্রথমেদের সাহায্যকারী দলগুলো দ্রুত স্থানে পৌঁছে, তবে পঞ্চাশের বেশি আহতদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।

আইএসআইএসের দায়িত্ব গ্রহণ
এই হামলার জন্য ইসলামিক স্টেট (আইএসআইএস) গ্রুপটি দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। এটি সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের পতনের পর প্রথম বড় আক্রমণ হিসেবে গণ্য হচ্ছে, যা ডিসেম্বর ২০২৪ সালে ঘটেছিল। আসাদের পরিবর্তে অধিকার গ্রহণকারী আন্তরিক রাষ্ট্রপতি আহমেদ আল-শারার নেতৃত্বে হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) সরকারটি ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সংখ্যালঘু দুই গোষ্ঠীর সুরক্ষা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তবে এই হামলা সেই প্রতিশ্রুতির উপর প্রশ্ন তুলে ধরেছে।

সিরিয়ার খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বিপদ
সিরিয়ার খ্রিস্টান সম্প্রদায়, যিনি কয়েক শতাব্দী ধরে এই অঞ্চলে বসবাস করছেন, গত কয়েক দশকে উত্তরণের মুখে রয়েছে। বিবিসির ২০১৫ সালের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৯২০-এর দশকে খ্রিস্টানরা সিরিয়ার জনসংখ্যার প্রায় ৩০% নিয়ে থাকতেন, যা বর্তমানে কমে ১০% এবং সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী এই সংখ্যা ৩ লক্ষের নিচে নেমে গেছে। এই হামলা সেই কমে যাওয়া সম্প্রদায়ের উপর আরও বড় আঘাত হিসেবে দেখা যাচ্ছে।
খ্রিস্টান সম্প্রদায় সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে সাধারণত নিরপেক্ষ ভূমিকা নিয়েছিলেন, তবে তারা বারবার উগ্রবাদী হামলার লক্ষ্য হয়ে থাকেন। এই ধরনের হামলা সিরিয়ার ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও শান্তি প্রক্রিয়ার উপর গভীর প্রভাব ফেলবে।

Advertisements

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
এই হামলার পর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক নেতা ও সংস্থা এই নৃশংসতার নিন্দা জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাজ্য সরকার জানিয়েছে যে তারা এই ঘটনাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছে এবং সিরিয়ার নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করবে উগ্রবাদ নিয়ন্ত্রণে। সংযুক্ত রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, “এই ধরনের হামলা সিরিয়ার শান্তি প্রক্রিয়াকে পিছিয়ে নিয়ে যাবে এবং আমরা সিরিয়ার নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”

সিরিয়ার বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি
বাশার আল-আসাদের পতনের পর সিরিয়া একটি সংকটময় পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আহমেদ আল-শারার নেতৃত্বাধীন এইচটিএস সরকার দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। রয়টার্সের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত কয়েক মাসে যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়া থেকে তার সামরিক উপস্থিতি কমিয়ে আনছে, যা আইএসআইএসের পুনরুদ্ধারের জন্য একটি সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এই হামলা সেই সুযোগের একটি ফলাফল হতে পারে।

উগ্রবাদের পুনরুদ্ধার
জার্নাল অফ কনফ্লিক্ট রেসোলিউশন-এর ২০২১ সালের একটি গবেষণা পত্রে উল্লেখ করা হয়েছে যে, যুদ্ধোত্তর অঞ্চলে নেতৃত্ব পরিবর্তনের পর উগ্রবাদী গোষ্ঠীর স্লিপার সেলগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে। সিরিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি তা প্রমাণ করছে। আইএসআইএস, যিনি ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সিরিয়া ও ইরাকের বৃহৎ অংশ নিয়ন্ত্রণ করেছিল, গত বছরগুলোতে নিষ্ক্রিয় ছিল। তবে নতুন সরকারের দুর্বলতা এই গোষ্ঠীকে আবার শক্তি সঞ্চয়ের সুযোগ দিয়েছে।

ভবিষ্যতের উদ্বেগ
এই হামলার পর সিরিয়ার নাগরিকদের মনে ভয় ও উদ্বেগ বাড়ছে। খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের নেতারা জানিয়েছেন যে তারা নিজেদের সুরক্ষার জন্য উদ্বিগ্ন এবং সরকারের কাছে সুরক্ষা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন। সিরিয়ার তথ্যমন্ত্রী হামজা মোস্তফা এই হামলাকে “নৃশংস কাজ” হিসেবে অভিহিত করে বলেছেন, “এই ধরনের হামলা আমাদের নাগরিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে। আমরা সমান নাগরিকত্বের প্রতি আমাদের প্রতিশ্রুতি থেকে পিছু হব না এবং সরকার অপরাধী সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে সব কিছু করবে।”

মার এলিয়াস চার্চে ঘটে যাওয়া এই হামলা মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রক্রিয়ার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত। সিরিয়ার নতুন সরকারের কাছে এটি একটি কঠিন পরীক্ষা। আইএসআইএসের পুনরুদ্ধার এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলা দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা ছাড়া এই সমস্যার সমাধান কঠিন হবে। সিরিয়ার নাগরিকরা এখন শান্তি ও সুরক্ষার প্রতীক্ষায় রয়েছেন, যা তাদের জীবনের মৌলিক অধিকার।