Anup Maji: ১৫০০০ কোটির কয়লা পাচারের ‘কিংপিন’, কে এই অনুপ মাজি ওরফে লালা?

এ গল্প (Anup Maji) হার মানাবে বলিউডকেও! পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রামের এক যুবক, খনি থেকে কয়লা চুরি করার মাধ্যমে যার ‘কেরিয়ার’ শুরু হয়েছিল, আজ সে ১৫০০০…

Anup-Maji

এ গল্প (Anup Maji) হার মানাবে বলিউডকেও! পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রামের এক যুবক, খনি থেকে কয়লা চুরি করার মাধ্যমে যার ‘কেরিয়ার’ শুরু হয়েছিল, আজ সে ১৫০০০ হাজার কোটি টাকার অবৈধ কয়লা পাচারের সঙ্গে যুক্ত। শুধু তাই নয়, তার অবৈধ ব্যবসার সূত্রেই আজ কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলির র‍্যাডারে একাধিক রাজনীতিবিদ, সরকারি আধিকারিক থেকে শুরু করে পুলিশের ছোট-বড় কর্তারা।

এই গল্প অনুপ মাজি ওরফে লালার। কয়লা পাচার কাণ্ডে মূল অভিযুক্ত লালা আজ, মঙ্গলবার সাতসকালে আসানসোলের বিশেষ সিবিআই আদালতে আত্মসমর্পণ করে। তাকে শর্তসাপেক্ষে জামিনও দিয়েছে আদালত। ১০ হাজার টাকার ব্যক্তিগত বন্ডে তাকে জামিন দেওয়া হয়। কিছু শর্তও দেওয়া হয়। একই সঙ্গে বিশেষ সিবিআই আদালতের বিচারক এই মামলার তদন্তে সিবিআইয়ের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

   

কয়লা কাণ্ডে এই লালার সূত্রেই সিবিআই তদন্তের মুখে পড়েছিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী রুজিরা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শ্যালিকা মেনকা গম্ভীর।

পূর্ব ভারতের কুখ্যত কয়লা মাফিয়াদের শীর্ষে রয়েছে লালা ওরফে অনুপ মাজি, এমনটাই দাবি কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার। মূলত পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম বর্ধমান জেলায় ছড়িয়ে লালার চোরা কারবার। প্রতিবেশী রাজ্য ঝাড়খণ্ডেও লালার নেটওয়ার্ক কাজ করে। এক সিবিআই আধিকারিকের মতে, সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে যোগসাজশ করেই লালা অবৈধ কাজকর্ম চালায়।

Coal Scam: বাংলায় নাটকীয় ঘটনা, আত্মসমর্পণ করল কয়লা পাচারকাণ্ডে মূল অভিযুক্ত অনুপ মাঝি

পুরুলিয়ার ছোট্ট গ্রাম ভামুরিয়ার গরিব পরিবারের জন্ম লালার। ছোট থেকে অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। চার ভাই আর তিন বোনের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর অবস্থা ছিল। ভামুরিয়া গ্রাম পশ্চিম বর্ধমান জেলার সীমানায় অবস্থিত। লালার বাবা ইস্টার্ন কোলফিল্ডস লিমিটেডের (ইসিএল) অধীনে ভামুরিয়া কয়লা খনির কর্মী ছিলেন।

ছোট থেকেই পড়াশুনায় একদমই অমনযোগী ছিল লালা। ব্যবসার করে প্রচুর অর্থ উপার্জনই ছিল একমাত্র লক্ষ্য। শৈশব থেকেই খুব উচ্চাকাঙ্খীও ছিল লালা। প্রথমে মাছ বিক্রি শুরু করলেও ধীরে ধীরে কয়লা খনির প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি পায় লালার। কয়েক জন বন্ধু ও আত্মীয়-পরিজনদের সাহায্যে একটি কারখানা গড়ে তোলে লালা। এরপর রঘুনাথপুর, আসানসোল এবং রানীগঞ্জ এলাকার ইসিএলের খনিগুলি থেকে কয়লা চুরি শুরু করে।

দ্রুত অর্থ উপার্জনের জন্য, মাজি রঘুনাথপুরের জঙ্গলে অবৈধ ভাবে কয়লা উত্তোলন শুরু করে। হাতে কিছুটা টাকা-পয়সা আসতেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অনুষ্ঠানে টাকা দিতে শুরু করে। এভাবেই বিভিন্ন নেতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে গড়ে ওঠে এই কয়লা মাফিয়ার। অনেকেই বলে থাকেন, এই বিষয়টিই গেমচেঞ্জার হয়ে উঠেছিল লালার জীবনে। কয়েক জন সরকারি আধিকারিকও ঘুষের বিনিময়ে লালার অবৈধ ব্যবসায় সাহায্য করতে থাকে।

Coal Scam: কয়লা কেলেঙ্কারি তদন্তে জেলায় জেলায় তল্লাশি

লালা তার গ্রামে জাঁকজমকপূর্ণ দুর্গাপুজো করার মাধ্যমেই প্রচারের আলোয় এসেছিল। প্রতি বছর, একজন করে বলিউড তারকা সেই পুজোর উদ্বোধন করতেন। তারপরে সেলিব্রিটিরা সপ্তাহব্যাপী পারফরম্যান্স করতেন। শুধু পুরুলিয়া নয়, বাঁকুড়া, বীরভূম, পশ্চিম বর্ধমান, ধানবাদের লোকেরাও দুর্গাপুজোর সময় সেখানে ভিড় জমাতেন।

ধীরে ধীরে লালার নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে পড়তে থাকে। রাজ্যের বেশিরভাগ খনি থেকে কয়লা চুরি শুরু করে সে। একই সঙ্গে কয়লা পাচারের দিকটিও তার নজরে ছিল। রাজ্যের মধ্যে কিংবা ভিনরাজ্যে পাচারের বিষয়টিও লালা দেখভাল করত।

Anup-Maji-lala
অনুপ মাজি ওরফে লালা (ডান দিকে)

লালা তার নেটওয়ার্ক প্রসারিত করতে থাকে। ক্রমেই রাজ্যের বেশিরভাগ খনি থেকে কয়লা চুরি শুরু করে। বাংলার অভ্যন্তরে এবং সীমানা পেরিয়ে ভিন রাজ্যে চোরাই কয়লা পরিবহণের দায়িত্বও সে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল। বাংলার প্রতিটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ভালো নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিল লালা। সূত্রের খবর, মাসিক ঘুষ বড় স্যুটকেসে পৌঁছে যেত নেতা-মন্ত্রী-আমলা-পুলিশদের কাছে।

Coal Scam: দীর্ঘ জেরা হবে মমতা পরিবারের বৌমা রুজিরার, কয়লা কেলেঙ্কারির সূত্র সন্ধানে ইডি

বছর চল্লিশের মাজির আয়রন প্রোডাক্ট ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট, রোলিং মিল, সিলিকেট কারখানা সহ প্রায় দু’ডজন শিল্প ইউনিট রয়েছে। কলকাতা এবং দিল্লিতে রিসর্টও রয়েছে লালার। অবৈধ ব্যবসা রমরমা বাড়াতে কুখ্যাত গরু পাচারকারী এনামুল হকের সঙ্গেও হাত মেলায় লালা। এনামুল বর্তমানে জেলে হেফাজতে রয়েছে। লালা-হকের সঙ্গে যুক্ত ছিল ফেরার তৃণমূল নেতা বিনয় মিশ্রও।

কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে খবর, মাঝির অবৈধ ব্যবসার পরিমাণ ১৫০০০ কোটি টাকার বেশি। ২০২০ সালের ২৮ নভেম্বর সিবিআই হানার আগে পর্যন্ত লালার নেটওয়ার্কের সঙ্গে প্রায় ৫০০০০ লোক জড়িত ছিল। ভোটের সময় রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রচুর টাকাও যোগাত লালা।

দক্ষ রাইফেল শ্যুটার হিসেবেও অনুপ মাজি পরিচিত। অনেক চ্যাম্পিয়নশিপেও অংশ নিয়েছে। ইদানিং কলকাতায় বেশিরভাগ সময় পরিবারের সঙ্গে কাটালেও লালা শিকড়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেনি কখনও। গ্রামের লোকেরাও ছোটখাটো সমস্যা নিয়ে প্রায়ই লালার কাছে আসে। অনেকের মতে, লালা তাদের সাধ্যমত সাহায্যও করে।

Coal smuggling: কয়লার কালো টাকা বাংলা সিনেমায় ব্যবহার হয়েছে বলে দাবি ইডির

রাজনৈতিক ও পুলিশি সুরক্ষায় থাকা লালা কয়েক দশক ধরে কেন্দ্রীয় এজেন্সিরগুলির চোখে ধুলো দিয়ে ব্যবসা চালিয়ে গিয়েছে। পুলিশের খাতায় ‘পলাতক’ থাকলেও সারা রাজ্যে টন প্রতি ৬০০০ টাকায় বিক্রি করছিল লালা। রাজনীতিবিদদের সহায়তায় ঝাড়খণ্ড, বিহার, ওডিশা, উত্তরপ্রদেশ এমনকি উত্তর-পূর্বেও বেআইনি কয়লা সরবরাহ করত অনুপ মাঝি ওরফে লালা।